সুশিক্ষিত পরিবারে জন্ম চাঁদনীর (ছদ্ম নাম)। বাবা-মা, ভাই-বোনের সঙ্গে থেকেই পড়ালেখাও চালিয়ে যাচ্ছেন।পরিবার তাকে সহজভাবে গ্রহণ করলেও প্রতিবেশী ও সমাজের লোকজনের কাছে তিনি যেন সাক্ষাৎ বিপত্তি। বাঁকা চোখে তার দিকে চেয়ে বলে, ‘ওই দেখ হিজড়া যায়। ’ অথচ জন্মের পর বাবা-মা যে নাম দিলো, সে নাম ধরে কেউ ডাকে না।
শারীরিক সমস্যা নিয়ে জন্ম। দোষটা যেন তাদেরই! তারা অলক্ষী, অশুচি। তাদের মুখ দেখলেও যেন অনিষ্ট যাত্রাপথ। সমাজের এমন সব বিষাক্ত কটুক্তি তাদের আত্মহত্যারও প্রবণতা যোগায়। সমাজের লোকজন গোত্রে আলাদা করে দিয়েছে তাদের হিজড়া নামে।
অথচ তাদেরও ঘর আছে, আছে স্বজন। অন্য সবার মতো মন আছে। আছে সুন্দর মতো বেঁচে থাকার অধিকার। কিন্তু পদে পদে সেই অধিকার খর্ব করছে কেবল তৃতীয় লিঙ্গের হয়ে জন্ম নেওয়ায়। নিজেদের কারণে স্বজনদের সমাজে হেয়প্রতিপন্ন না হতে ঘর ছাড়েন তারা। খোঁজে নেন গোত্র, স্বজাতিদের। তারা স্বজন না হলেও একে অন্যকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকেন হিজড়া জনগোষ্ঠী নামে। কিন্তু স্বজন, সমাজ কিংবা রাষ্ট্রে তাদের দুঃখ বুঝার কেউ থাকে না।
দু’মুঠো অন্ন সংস্থানে জড়াতে হয় ভিক্ষাবৃত্তিসহ অপকর্মে। একসময় রোগ-শোকে ভুগতে ভুগতে অবসান হয় গ্লানিময় জীবনের। অন্তত বাংলাদেশে হিজড়াদের জীবন বলতে গেলে একই রকম।
মুক্তা হিজড়া (২৩)। বাড়ি নেত্রকোনার মোহনগঞ্জে। ১৪ বছর বয়স থেকে ঘর ছাড়তে ছাড়তে হয়েছিল তাকে। এখানে ওখানে শহরের পর শহর ঘুরে সিলেটে আসা। সিলেট হোক কিংবা ঢাকা। সব স্থানেই জীবন গণ্ডিতে বাঁধা। অন্যান্য হিজড়াদের সঙ্গে মিলে চলে ভিক্ষাবৃত্তি। ‘যা সমাজের চোখে চাঁদাবাজি তা আমাদের চোখে খাবার সংস্থান। কোনো বাড়িঘর কিংবা অট্টালিকা গড়তে নয়। নইলে খামু কি? খাওয়াবে কে?’- সাফ জবাব তার।
মুক্তার মতো পৈতৃক সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে থাকা হিজড়ারা। হিন্দু-মুসলিম, কোনো ধর্মের আইন তাদের জন্য নয়। নেই রাষ্ট্রের আইনও। তাই, ‘গুরুমা’র অধিনেই চলে জীবন। সেই গুরুমার নির্দেশে তারা হাট-বাজারে, মার্কেটে, বিয়ে বাড়িতে, গাড়িতে, সংঘবদ্ধভাবে ভিক্ষাবৃত্তির নামে টাকা বা খাদ্যপণ্য সংগ্রহ করেন। তা ভাগাভাগি করে কোনোরকমে বেঁচে থাকা।
এলিজারও (ছদ্মনাম) স্বপ্ন ছিল বাবা-মায়ের সঙ্গে বেড়ে ওঠার। কিন্তু শারিরিক সমস্যা নিয়ে জন্ম হওয়ায় তাকে পরিবার ও সমাজ দূরে সরিয়ে দিলো। সহপাঠীরাও তার সঙ্গে খেলতো না। ডাকতো ‘লেডিস’ বলে। তার কথায়, সমাজের লোকজন আমাকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে পরিচয় করিয়ে দেয় তুই হিজড়া। তোর স্থান এখানে না। যে কারণে মাত্র ৯ বছর বয়সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসা।
এলিজা বলেন, বাবা-মায়ের সন্তান প্রতিবন্ধি হলেও তাকে ঘরে রাখে। পুষে বড় করে। পরিবারে স্থান পায়। তাহলে আমাদের বেলায় কেন এমন হয়? আমরা তো নিজে থেকে এমন হইনি। সৃষ্টিকর্তা যেভাবে সৃষ্টি করেছেন, তাতে মানুষ হেয় করবে কেন? আমাদের বেলায় কেন সমাজের লোকজনের দৃষ্টিভঙ্গি এমন? প্রশ্ন এলিজার।
বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী, সব নাগরিকের সমান অধিকার নিশ্চেতের কথা বলা হলেও হিজড়ারা প্রায় সবক্ষেত্রেই বঞ্চিত। আইনী বাধা না থাকলেও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি, নানা কুসংস্কারের কারণে তাদের ঘর ছাড়তে হয়। দেখিয়ে দেওয়া হয় তোমার স্থান এই সমাজে নয়। আর সমাজচ্যুত হওয়ায় পরতে পরতে হতে হয় বঞ্চনার শিকার। হাসপাতালে গেলে চিকিৎসা পান না। বঞ্চিত শিক্ষাক্ষেত্রেও। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গেলেও তাদের নিয়ে কটাক্ষ করা হয়। দ্বিধায় ক্লাস ছেড়ে বেরিয়ে আসতে বাধ্য হতে হয়।
সম্প্রতি এনজিও সংস্থা ‘বন্ধু’র সহায়তায় হিজড়াদের চিকিৎসা সেবা দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। তাদের জীবনমান উন্নয়নে বাংলাদেশ সরকারেরও পাশে দাঁড়ানো প্রয়োজন। যদিও গত কয়েক বছর থেকে সেলাই প্রশিক্ষণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সরকার। একটা বছরের একটা নির্দিষ্ট সময়ে জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উদ্যোগে প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। পাশাপাশি প্রশিক্ষণার্থীদের দৈনিক একহাজার টাকা ভাতাও দেওয়া হচ্ছে। প্রশিক্ষণ শেষে সেলাই মেশিন কেনার জন্যও টাকা দেয়া হয়। কখনো কর্মকর্তারাই তা কিনে দিচ্ছেন। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া যাচ্ছে না।
সম্প্রতি প্রশিক্ষণ শেষে কতজন হিজড়া কাজে লেগেছে বা আয়-রোজগার করছেন- জানতে সিলেট জেলা সমাজসেবা অফিসে গেলে পরিচালক নিবাসরঞ্জন দাস এ সংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য দিতে পারেননি। তার কথা, ‘কাজ করছে অনেকে, ব্যবসাও করছে। ‘
নেতৃস্থানীয় হিজড়ারা প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণের সুযোগ পাইয়ে দেওয়ার বিনিময়ে দৈনিক ভাতার প্রায় অর্ধেকটা নিজেরাই নিয়ে নেন। এমন একটা ঘটনাও প্রকাশ্যে এসেছিল। তবে হিজড়াদের জীবনমান উন্নয়নে সরকারকে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ প্রয়োজন মনে করছে সচেতন মহল।