পরীক্ষাভিত্তিক সামষ্টিক মূল্যায়ন হ্রাস করে বিকল্প মূল্যায়নের সুযোগ বাড়ছে নতুন কারিকুলামে। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) নতুন ‘প্রাক-প্রাথমিক থেকে দ্বাদশ শ্রেণির জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা’য় মূল্যায়ন ও রিপোর্টিং ব্যবস্থা অনুচ্ছেদে এমন রূপরেখা দেওয়া হয়েছে।
এতে উল্লেখ করা হয়, গতানুগতিক পরীক্ষাভিত্তিক বা সামষ্টিক মূল্যায়ন হ্রাস করা হবে। চালু হবে বিকল্প মূল্যায়ন (স্ব-মূল্যায়ন, সহপাঠী বা দল কর্তৃক মূল্যায়ন ইত্যাদি)। এই পদ্ধতিতে মূল্যায়নের মূলনীতি অনুসরণ করে শিক্ষার্থীর যোগ্যতার মূল্যায়ন করা হবে। মূল্যায়নের ধারাবাহিক রেকর্ড সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনায় আসবে নতুনত্ব।
নতুন কারিকুলামে মূল্যায়ন নির্দেশকগুলো হচ্ছে- শিখনকালীন মূল্যায়নের ওপর গুরুত্ব দিয়ে বহুমাত্রিক উপায়ে মূল্যায়ন; শিখনের জন্য মূল্যায়ন; মূল্যায়নের মাধ্যমে শিখন; পর্যবেক্ষণ; প্রতিফলনভিত্তিক ও প্রক্রিয়ানির্ভর মূল্যায়ন; ধারাবাহিক মূল্যায়ন; সতীর্থ মূল্যায়ন; অংশীজন মূল্যায়ন; মূল্যায়নে টেকনোলজির (অ্যাপস) ব্যবহার; মূল্যায়নে জ্ঞান, দক্ষতা ও দৃষ্টিভঙ্গি বিবেচনা করা।
এ বিষয়ে এনসিটিবির সদস্য (শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান বলেন, মূল্যায়ন শিক্ষাব্যবস্থার একটি অপরিহার্য ও গুরুত্বপূর্ণ অংশ। শিক্ষাক্রম রূপরেখায় মূল্যায়নকে কেবল শিক্ষার্থীর শিখন মূল্যায়নের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে পুরো শিক্ষাব্যবস্থার কার্যকারিতা মূল্যায়ন, শিখন পরিবেশের মূল্যায়ন এবং সেই সঙ্গে শিখনের মূল্যায়নের ওপর জোর দেওয়া হবে নতুন কারিকুলামে। প্রচলিত মূল্যায়ন ব্যবস্থার ব্যাপক সংস্কারের মাধ্যমে মুখস্থ বিদ্যাভিত্তিক পরীক্ষা পদ্ধতি থেকে সরে এসে বহুমাত্রিক মূল্যায়নের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর বিভিন্ন মাত্রার জ্ঞান, দক্ষতা, মূল্যবোধ, গুণাবলি ও চেতনা বিকাশের ধারাকে মূল্যায়নের আওতায় আনা হয়েছে। সব ধরনের শিখন মূল্যায়নের ভিত্তি হবে যোগ্যতা।
তিনি আরও বলেন, যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রমের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো জ্ঞান, দক্ষতা, মূল্যবোধ ও গুণাবলির মধ্যে আন্তঃস¤পর্ক বিবেচনায় নিয়ে যোগ্যতার পরিমাপ করা। কাজেই জ্ঞান, দক্ষতা, মূল্যবোধ ও গুণাবলিকে পৃথকভাবে মূল্যায়ন না করে এই উপাদানগুলোর মিথস্ক্রিয়ায় অর্জিত সক্ষমতার মূল্যায়ন করা জরুরি।
পাঠ্যক্রমে পরীক্ষানির্ভরতা কমিয়ে আনা প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, আমাদের লেখাপড়া পরীক্ষানির্ভর। এখান থেকে বের হয়ে আসার চিন্তা করছে সরকার- এটি ইতিবাচক। বর্তমানের দ্রুত পরিবর্তনশীল পৃথিবীর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য শুধু জ্ঞান অর্জন করলে চলবে না। অর্জিত জ্ঞানকে পরিবেশ অনুযায়ী অভিযোজনের জন্য প্রয়োগ করার দক্ষতা এবং দৃষ্টিভঙ্গিও অর্জন করতে হবে। কাজেই শিখন কোনো পূর্বনির্ধারিত আচরণ হুবহু অর্জন করা নয়, বরং শিক্ষার্থীর সঙ্গে পরিবেশের অবিরাম মিথস্ক্রিয়া- যার মাধ্যমে তার বৈশিষ্ট্য ও পারদর্শিতা এবং পরিবেশের উপাদান উভয়ের মধ্যেই পরিবর্তন ঘটবে। এই পদ্ধতি যথাযথ বাস্তবায়ন হলে শিক্ষার্থী পরিবেশের সঙ্গে অভিযোজনের জ্ঞান-দক্ষতা-দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করতে পারবে। তবে এ জন্য আমাদের শিক্ষকদের যথোপযুক্ত দক্ষতার প্রয়োজন আছে।
নতুন কারিকুলাম অনুযায়ী, প্রাক-প্রাথমিক পর্যায়ে শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে ১০০ নম্বর। প্রথম-তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পরীক্ষা নেই, শিখনকালীন মূল্যায়নে ১০০ নম্বর। চতুর্থ-পঞ্চম শ্রেণিতে পাঁচ বিষয়ে (বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞান) শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে ৬০ নম্বর, বাকি ৪০ নম্বরের পরীক্ষা। তিন বিষয়ে (শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য এবং সুরক্ষা, ধর্ম শিক্ষা এবং শিল্পকলা) কোনো পরীক্ষা হবে না, ১০০ নম্বরের শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে। ষষ্ঠ-অষ্টম শ্রেণিতেও পাঁচ বিষয়ে (বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞান) শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে ৬০ নম্বর, বাকি ৪০ নম্বরের পরীক্ষা। আরও পাঁচ বিষয়ে (জীবন ও জীবিকা, ডিজিটাল প্রযুক্তি, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য এবং সুরক্ষা, ধর্ম শিক্ষা এবং শিল্প ও সংস্কৃতি) কোনো পরীক্ষা হবে না, ১০০ নম্বরের শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে। নবম-দশম শ্রেণিতে পাঁচ বিষয়ে (বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞান) শিখনকালীন মূল্যায়ন ৫০ নম্বর এবং পরীক্ষা হবে ৫০ নম্বরের। এর সঙ্গে পাঁচ বিষয়ে (জীবন ও জীবিকা, ডিজিটাল প্রযুক্তি, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য এবং সুরক্ষা, ধর্ম শিক্ষা এবং শিল্প ও সংস্কৃতি) ১০০ নম্বরের শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে। দশম শ্রেণি শেষে শুধু এই শ্রেণির পাঠ্যসূচির ওপর ভিত্তি করে পাবলিক পরীক্ষা হবে। একাদশ ও দ্বাদশে আবশ্যিক বিষয়ে শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে ৩০ নম্বরের, পরীক্ষা হবে ৭০ নম্বরের। নির্বাচনিক/বিশেষায়িত বিষয়ে কাঠামো ও ধারণায়ন অনুযায়ী সামষ্টিক মূল্যায়নের পাশাপাশি প্রকল্পভিত্তিক, ব্যবহারিক ও অন্যান্য উপায়ে শিখনকালীন মূল্যায়নের সুযোগ থাকবে। প্রয়োগিত বিষয়ে শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে ১০০ নম্বরের। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির পাঠ্যসূচির ওপর প্রতি বর্ষ শেষে একটি করে পাবলিক পরীক্ষা হবে। দুই পরীক্ষার ফলের সমন্বয়ে চূড়ান্ত ফল নির্ধারিত হবে।