মাগুরার শ্রীপুর গ্রামের বাসিন্দা মোমেনা বেগমের পাঁচ ছেলে আর তিন মেয়ের সংসার ছিলো। সবকিছু ঠিকঠাক চলছিল মোমেনার। কিন্তু স্বামীর মৃত্যুর পর সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেল তাঁর। উপার্জনক্ষম ৫ ছেলে থাকলেও মোমেনা বেগমের এক বেলা ভাতও জোটেনি। শুধু তাই নয়, জমি-জমা লিখে নেওয়ার জন্য প্রায় সময় তাকে পাঁচ ছেলেই মারধর করতো।
এদিকে ৩ মেয়ের বিয়ে হয়ে যাওয়ায় তারাও শ্বশুরবাড়ি চলে যায়। ছেলেদের এসব অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে মোমেনা বেগম অবশেষে অভিযোগ দিতে যান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ে। আর এতে ক্ষিপ্ত হয়ে আবারও মাকে বেদম মারধর করে ইব্রাহিম নামে এক ছেলে। পরে আহত অবস্থায় গত ৩০ আগস্ট তাকে ভর্তি করা হয় ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট মাগুরা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। সুস্থ হয়ে ছাড়পত্র পেয়ে মা আবার আসেন ইউএনও কার্যালয়ে। এবার ইউএনও বিচারের জন্য লিখিত নোটিশ পাঠান পাঁচ ছেলের নামে। ইউএনও অফিসে পুলিশ যখন সেই ছেলের হাতে হ্যান্ডকাফ পরায়, তখন ছেলের কান্না দেখে মা অঝোরে কাঁদতে কাঁদতে তাদের মাফ করে দেওয়ার জন্য কাকুতি মিনতি করতে থাকেন।
সোমবার (৬ সেপ্টেম্বর) শ্রীপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ে এ ঘটনা ঘটে।
কান্নারত অবস্থায় ইউএনওকে জড়িয়ে ধরে মোমেনা বেগম বলেন, স্যার আমার মনিগের পুলিশে নিয়ে গেলে মারবেনে। আমার মনিরা ভুল করে ফেলিচে, এবারের মতো মাফ করে দেন। আবার যদি আমারে মারে তালি ওকে জেলে ঢুকোয়ে দেবেন।
ঘটনাস্থলে উপস্থিত এসিল্যান্ডসহ (সহকারী কমিশনার ভূমি) উপজেলার অন্যান্য কর্মকর্তারা বলেন, প্রকৃত মা কখনো ছেলের কষ্ট সইতে পারে না। যে মা একটু আগে নিজের ছেলের বিচার দাবি করেন। পরে সেই মা আবার ছেলেকে ছেড়ে দিতে পুলিশকে অনুরোধ করেন।
বিচার কাজে জেরা করছেন ইউএনও লিউলা-উল জান্নাহ। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ইউএনও আদেশ দেন, প্রত্যেক ছেলেকে মাসে এক হাজার করে টাকা মায়ের ভরণপোষণের জন্য দিতে হবে আর যে ছেলের হাতে মারধরে জখম হয়ে মা মোমোনা বোগমকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছিল, সেই ছেলের নামে নিয়মিত মামলা করা হবে থানায়। এ সময় সেই ছেলেকে থানায় নিয়ে যাওয়ার জন্য পুলিশকে নির্দেশ দিলে পুলিশ তার হাতে হ্যান্ডকাফ পরায়। এ সময় সেই ছেলে কেঁদে ফেললে মা আর স্থির থাকতে পারলেন না।
মোমেনা বেগম বলেন, ‘প্রায় চার বছর ধরে জমি-জমা নেকে (লিখে) নিয়ার জন্যি পাঁচ ছওয়ালই আমারে ধরে মারে। আমার ঘর থেকে নামে যাতি কয়। আমি ইউএনও ছারের (স্যারে) কাছে বিচার চাইছি বুলে আমার ছওয়াল আয়েব আলী আমারে মারে হাসপাতালে পাঠাইছে। মরেই যাতাম। আল্লাহ বাঁচায় দেছে। ’
মাকে কেন মেরেছেন?- জানতে চাইলে মোমোনা বেগমের অভিযুক্ত ছেলে আয়েব আলী বলেন, “আমি যখন শুনলাম মা আমার নামে ইউএনও স্যারের কাছে কেস করিচে, তখন মাথা ঠিক ছিলো না। এ রকম ভুল আর করব না। ’
ইউএনও অফিসে উপস্থিত অন্য তিন ছেলে ইব্রাহিম খলিফা, জাহিদ খলিফা ও নুর ইসলাম তাদের মাকে মারধরের কথা অস্বীকার করে বলেন, এখন থেকে আমরা সবাই মার ভরণপোষণের জন্য প্রতিমাসে এক হাজার করে টাকা দিয়ে দেব। এ সময় তারা জমি-জমা ভাগ করে দেওয়ার জন্য দাবি করেন। সুরুজ নামে মোমেনা বেগমের অপর ছেলে এ সময় সেখানে অনুপস্থিত ছিলেন বলে তার মতামত পাওয়া যায়নি।
শ্রীপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা লিউলা-উল-জান্নাহ বলেন, লিখিত অভিযোগের ভিত্তিতে বিচারের জন্য মোমেনা বেগমের পাঁচ ছেলেকে নোটিশ করা হয়েছিলো। জিজ্ঞাসবাদ শেষে ভরণপোষণের জন্য পাঁচ ছেলে মাসে এক হাজার টাকা করে মাকে দেবে মর্মে লিখিত মুচলেকা নেওয়া হয়েছে। আর যে ছেলের মারধরের কারণে মোমেনা বেগমকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছিলো তার নামে নিয়মিত মামলা করার নির্দেশ দিয়ে পুলিশে সোপর্দ করা হয়। কিন্তু মায়ের কান্নাকাটির কারণে এবং মামলা করতে রাজি না হওয়ায় আমি বিষয়টি ওসি সাহেবের ওপর ছেড়ে দিই।
এ বিষয়ে শ্রীপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সুকদেব রায় বলেন, বৃদ্ধা মায়ের আকুতি মিনতির কারণে এবারকার মতো মুচলেকা নিয়ে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তবে শ্রীপুর থানা পুলিশ নিয়মিত খোঁজ খবর রাখবে।