চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে ওষুধ পাচার, রোগীদের জিম্মি করে অর্থ আদায়, পছন্দের ল্যাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করানোসহ রোগী হয়রানির চিত্র বহু পুরোনো। রোগীদের পকেট পতুর করা দীর্ঘদিনের অনৈতিক রীতি এখনও স্বাভাবিক বৃহৎ এ হাসপাতালে। এবার নতুন করে আলোচনা জন্ম দিয়েছে, মহামারী করোনার এ দুঃসময়ে কোভিড রোগীদের জিম্মি করে অর্থ আদায়সহ নানা অনিয়ম।
এরমধ্যে বিপ্লব বেপারী। যিনি দায়িত্বে আছেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের রেড জোন-২ (কোভিড) এর ইনচার্জের। অথচ তার বিরুদ্ধেই অভিযোগ, রোগীদের জন্য বরাদ্দ দেয়া ইনজেকশন সরিয়ে ফেলার। ওয়ার্ডে আসা ওষুধ কোম্পানির এমআরদের মাধ্যমে এমন কাজটি করতেন তিনি। ওষুধ পাচার ছাড়াও কোভিড নমুনা পরীক্ষার নামেও অর্থ আদায়ের অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। এ যেন শিয়ালের কাছেই মুরগি বর্গা দেয়ার মতো।
শুধু বিপ্লব বেপারীই নয়, অভিযোগ রয়েছে, চমেক হাসপাতালে বহিরাগত ছাড়াও কিছু অসাধু কর্মচারীই রোগী জিম্মীর সাথে সরাসরি জড়িত।
যদিও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কোভিড রোগীদের সেবায় আন্তরিক। কিন্তু কিছু অসাধু কর্মচারী ও নার্সের কারণে সেবা কার্যক্রমে ব্যাঘাত হচ্ছে। যার বিষয়ে খোদ পরিচালক নিজেই ‘লজ্জিত’ বলে গত শনিবার এক অনুষ্ঠানে বক্তব্যও দিয়েছেন। সেখানে তিনি রোগীদের বরাদ্দ ওষুধ পাচার হওয়ার বিষয়ে স্পষ্ট বক্তব্যে বলেছিলেন, ‘যখন কাগজে দেখি সাধারণ প্যারাসিটামল রোগীদের কিনতে হয়, তখন লজ্জায় মাথা নত হয়ে আসে। অনেক সময় ওষুধ পায় না রোগীরা। সরকার এত টাকা খরচ করে, ওষুধ যায় কোথায়? এটা ভাঙতে হবে।’
পরিচালকের বক্তব্যের একদিন পরই স্বাস্থ্য সেবার বৃহৎ এ প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালিয়েছে র্যাব ও জেলা প্রশাসনের যৌথ ভ্রাম্যমাণ আদালত। অভিযানে সরকারি ও আউটসোর্সিং কর্মচারীসহ সর্বমোট ১১ জনকে রোগীদের কাছ থেকে অর্থ আদায়, হয়রানিসহ নানা অভিযোগে আটক করে। যাদের মধ্যে পাঁচজনকে কারাদ- প্রদান করেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। এরমধ্যে মো. সালাহউদ্দিন, মো. রাসেল হোসেন, মো. ইকবাল মিয়া, মো. আবু জাফর, বাদল দাশকে এক থেকে দুই মাস করে কারাদ- দিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। একই অভিযোগে মো. মমিন ও মো. ইসতিয়াক মোহাম্মদ ফরহাদ ২০ হাজার টাকা করে অর্থদ- দেয়া হয়। দ-িত এ সাতজন হাসপাতালের আউটসোর্সিং কর্মী হিসেবে কর্মরত।
র্যাব ও হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, র্যাব সদস্যরা এক নার্স ও তিন কর্মচারীকে আটক করলেও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ নিজেদের জিম্মায় নিয়ে ছাড়িয়ে নেন। এরমধ্যে চতুর্থ শ্রেণী সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক নুরুল আনোয়ার, কর্মচারী সুমন বড়–য়া, মো. কায়েস রয়েছেন। কোভিড ওয়ার্ড-২ এর ইনচার্জ বিপ্লব বেপারীকেও একই অভিযোগে আটক করে র্যাব। কিন্তু তাকেও জিম্মায় নিয়ে ছাড়িয়ে নেন কর্তৃপক্ষ। র্যাবের অভিযানের খবর পেয়ে হাসপাতালের পরিচালক নিজেই তাঁর কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসেন এবং ম্যাজিস্ট্রেটসহ সংশ্লিষ্টদের নিয়ে নিজ কক্ষে দীর্ঘ আলোচনায় বসেন। আলোচনায় সরকারি স্টাফদের জিম্মায় নেন।
নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মামনুন আহমেদ অনিক বলেন, ‘চিকিৎসা সেবার নামে সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে অসাধু উপায়ে অর্থ আদায়ের বিষয়ে সকাল থেকেই অভিযান চালানো হয়। এসময় হাতেনাতে বেশ কয়েকজনকে আটক করা হয়। এরমধ্যে সাতজনকে আমরা বিভিন্ন মেয়াদে ভ্রাম্যমাণ আদালতে সাজা দেয়া হয়েছে। দালালদের উৎপাতের খবর পেয়েই এ অভিযান। যা নিয়মিত পরিচালিত হবে।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. আফতাবুল ইসলাম বলেন, ‘এই বিষয়ে ডাইরেক্টর স্যারের সাথে মিটিং হয়েছিল। আমি মিটিংয়ে ছিলাম না, আমাদের কাজ বেশি থাকাতে, সেগুলো সামাল দিতে হয়েছিল। এরপরের বিষয়টি আমার জানা নেই। আমি নামাজে চলে গেছি। আপনি স্যারকে (পরিচালক) জিজ্ঞেস করুন’। সরকারি স্টাফদের ছাড়িয়ে নেয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘লম্বামিটিং ছিল, সেখানে কী হয়েছে সেটা আমি জানি না।’
হাসপাতালে দালাল বিরোধী র্যাব ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের অভিযানের বিষয়ে জানতে পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এস এম হুমায়ুন কবীরের সঙ্গে মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু তিনি ফোন রিসিভ করেননি। পরে ক্ষুদে বার্তা পাঠানো হলেও কোন সাড়া পাওয়া যায়নি।