স্বাস্থ্য

শিশুর ডিপথেরিয়া রোগের লক্ষণ, কারণ ও প্রতিকার

(Last Updated On: )

আজকের লেখার শিরোনাম দেখে আপনারা নিশ্চয়ই অবাক হচ্ছেন। অনেকেই ভাবছেন, আজকের পৃথিবীতে ডিপথেরিয়ার মতো রোগকে আধুনিক চিকিৎসা এবং টিকার সাহায্যে প্রায় নিশ্চিহ্নই যখন করে ফেলা গিয়েছে, তখন কেন হঠাৎ আমরা ডিপথেরিয়া নিয়ে আলোচনা করতে চলেছি? কোভিড পরবর্তী পৃথিবীতে আমরা অনেক বেশি সতর্ক হচ্ছি ছোঁয়াচে রোগ নিয়ে। টিকাকরণই হোক, বা তার আগে মাস্ক পরে, হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করে সতর্কতা অবলম্বন করছি কমবেশি আমরা সকলেই। কোভিডের মতো ডিপথেরিয়াও কিন্তু একটি ছোঁয়াচে অসুখ।

এবং তার চেয়েও বড় কথা, এই রোগটি বাচ্চাদের মধ্যেই বেশি দেখা যায়। শিশুরা নিজেদের অসুবিধা সহজে প্রকাশ করতে পারে না, তার উপর টিকাকরণের মাধ্যমে এই প্রাণঘাতী রোগটিকে কমিয়ে ফেলা সম্ভব হলেও ভারতীয় উপমহাদেশ সহ পৃথিবীর বহু দেশেই অশিক্ষা, অজ্ঞতার কারণে বহু বাবা-মা-ই বাচ্চার আবশ্যিক ডিটিপি (ডিপথেরিয়া-টিটেনাস-পারটুসিস) টিকাকরণে গুরুত্ব দেন না। ফলে অজান্তেই বাড়তে থাকে রোগ। সেইসঙ্গে ডিপথেরিয়া রোগের লক্ষণ ও কারণ সম্পর্কে যথাযথ ধারণা না থাকার ফলে অনেকসময় দেরি হয়ে যায় ডাক্তার দেখাতেও। তাই আপনার শিশুর ডিপথেরিয়া হয়েছে কিনা, ডিপথেরিয়া হলে কী হয়, এর লক্ষণগুলি কী এবং কী করে ডিপথেরিয়ার প্রতিকার করবেন, তাই নিয়ে আজ আলোচনা করব।

ডিপথেরিয়া কী? কেন হয়?

ডিপথেরিয়া একধরনের ছোঁয়াচে অসুখ। কর্নিব্যাকটেরিয়াম ডিপথেরি নামক ব্যাকটেরিয়ার কারণে এই রোগ হয় এবং এই ব্যাকটেরিয়া শিশুদের নাক এবং গলার মিউকাস পরদাকে আক্রমণ করে। ডিপথেরিয়ার চিকিৎসা ঠিক সময়ে শুরু না করলে এবং আপনার সন্তানের টিকা নেওয়া না থাকলে অনেকসময় তা শিশুর প্রাণসংশয়ের কারণও হয়ে উঠতে পারে। হাঁচি, কাশির মাধ্যমে ড্রপলেটের সাহায্যে এই ভাইরাস সহজেই একজনের শরীর থেকে অন্যজনের শরীরে ছড়িয়ে পড়তে পারে। অনেকসময় ডিপথেরিয়া হলে সেটি বাইরে থেকে বোঝা যায় না। তাছাড়া, হাঁচি বা কাশির সময় মুখে চাপা দেওয়ার সচেতনতা শিশুদের ক্ষেত্রে থাকে না, ফলে তাদের ক্ষেত্রে এই ভাইরাস দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। নিরক্ষীয় অঞ্চলে এবং অস্বাস্থ্যকর স্থানে যারা থাকেন, তাঁদের ক্ষেত্রে এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।

ডিপথেরিয়া রোগের লক্ষণ

সাধারণভাবে ডিপথেরিয়া রোগের ব্যাকটেরিয়া নাক ও গলাকে আক্রান্ত করে। সাধারণত এর ফলে গলাব্যথা, কাশি, ত্বক নীলচে হয়ে যাওয়া, গলায় খুসখুসে ভাব, অস্বস্তি, হালকা জ্বর, দুর্বলতা ইত্যাদি লক্ষণ দেখা যায়। অনেকের ক্ষেত্রে ঢোঁক গেলার ক্ষেত্রে ও শ্বাসের ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা যায়। এছাড়া লসিকাগ্রন্থির আয়তন বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে গলাও ফুলে যায়। এক্ষেত্রে আক্রান্ত স্থানে মোটা ধূসর বর্ণের একটি আস্তরণ দেখতে পাওয়া যায়। সবধরনের ডিপথেরিয়া ব্যাকটেরিয়ার স্ট্রেনে লক্ষণগুলি প্রকাশ পায় না।

কিছু ক্ষেত্রে ডিপথেরিয়া হলে উপসর্গহীনতা যেমন দেখা যায়, তেমনই আবার অনেকক্ষেত্রে রক্তে বিষক্রিয়ার ফলে ত্বকের ক্ষেত্রে ইনফেকশন দেখা যায়। গুরুতর ক্ষেত্রে নাক ও গলা থেকে এই ব্যাকটেরিয়া শিশুর বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গকেও আক্রমণ করে। উপরের উপসর্গগুলির পাশাপাশি চোখে দেখার সমস্যা, কথা জড়িয়ে যাওয়া, শ্বাসকষ্ট, হৃৎস্পন্দন বৃদ্ধি পাওয়া, ত্বক ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়ার উপসর্গ থাকলে বুঝবেন আপনার শিশুর ডিপথেরিয়া রোগটি বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে হৃৎপিণ্ডের পেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যা হার্ট ফেলিয়োরের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

এছাড়া স্নায়ুতন্ত্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করে প্যারালাইসিসের সম্ভাবনা বৃদ্ধি করে। শ্বাসকষ্টও হতে পারে। ঠিক সময়ে চিকিৎসা শুরু না হলে তা অনেকসময় জটিল আকার ধারণ করে। ফলে আপনার বাড়িতে ছোট শিশু থাকলে তার প্রতি বিশেষভাবে যত্নবান হন, সে সামান্য কোনও অসুবিধার কথা প্রকাশ করলে সেটি মন দিয়ে শুনুন। যথাযথ ডাক্তার দেখান।

কীভাবে করবেন ডিপথেরিয়ার প্রতিকার ?

প্রথমেই উচিত যথাযথ সময়ে টিকাকরণ। এখন ডিপথেরিয়ার মতো রোগ টিকার সাহায্যে খুব কার্যকরীভাবে প্রতিরোধ করা সম্ভব হচ্ছে। সাধারণত এক্ষেত্রে ডিটিপি টিকা দেওয়া হয়ে থাকে। এই টিকাকরণের ফলে ডিপথেরিয়া রোগে আক্রান্তের পরিমাণও দিন-দিন উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পাচ্ছে। বিভিন্ন দেশে নির্দিষ্ট গণ টিকাকরণ কর্মসূচি রয়েছে। ডাক্তার দেখিয়ে কোন টিকা আপনার শিশুর ক্ষেত্রে কখন প্রয়োজন তার তালিকা সংগ্রহ করুন। সেই অনুযায়ী তাকে নিকটবর্তী স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যান।

যেহেতু এই রোগ বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রেই বেশি হয়, তাই এবিষয়ে যত্নবান হতে হবে তার আম্মু-আব্বুকেই। শিশুর মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই হাইজিনের বোধ থাকে না, অনেকসময়তেই সে নোংরা ঘেঁটে মুখে হাত দিয়ে দেয় বা হাঁচি-কাশির সময় মুখে চাপা দেয় না। এগুলি আপনি হাজার বলেও আটকাতে পারবেন না। তাই বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত। বেশি ভিড় স্থানে আপনার সন্তানকে নিয়ে না যাওয়াই ভাল। এতে ব্যাকটেরিয়া বাহিত ছোঁয়াচে রোগের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়। তাকে পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন রাখুন।

এখন করোনার কারণে সকলেই মাস্ক পরছে, আপনার সন্তানকেও মাস্ক পরা অভ্যেস করুন। এতে করে সে সুরক্ষিত থাকবে। তবে খেয়াল রাখবেন, এই মাস্ক যেন কাপড়ের হয়। দেহে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা না বৃদ্ধি পেলে ডিপথেরিয়ার মতো ব্যাকটেরিয়া ঘটিত রোগ সহজেই আক্রমণ করে। তাই আপনার সন্তানের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ান। তাকে ভিটামিন সি, আয়রন যুক্ত খাবার বেশি করে খেতে দিন। দেখবেন, ডিপথেরিয়ার মতো ভয়ংকর রোগকেও সচেতনতা অবলম্বন করে আপনার শিশুর থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে সক্ষম হচ্ছেন।