মৌসুমী আক্তার, বয়স আনুমানিক ৩০ বছর। বাস করেন রাজধানীর কদমতলী এলাকায়। ২০২০ সালের জুন মাসে করোনাকালীন সময়ে অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন তিনি। এই সময়ে আলপনা নামের এক নারীর মাধ্যমে ‘লোভনীয়’ একটি প্রস্তাব পান মৌসুমী।
মৌসুমীকে জানানো হয়, অদ্ভুত এক ধরনের ‘সেবা কার্ডের’ কথা। মাত্র ৫ হাজার টাকা জমা দিয়ে ওই কার্ড করতে পারলে ৬ মাস পরে ৫০ হাজার টাকা পাবেন তিনি। ৫ হাজার টাকা ৬ মাস পরে ৫০ হাজারে পরিণত হবে এমন লোভনীয় সুযোগ কে-ই বা হাতছাড়া করতে চায়। তাই কোনো কিছু না ভেবেই দ্রুত ৫ হাজার টাকা জমা দিয়ে সংশ্লিষ্ট নামধারী প্রতিষ্ঠানে গিয়ে ‘সেবা কার্ড’ করেন মৌসুমী।
আর সেই ‘সেবা কার্ড’ নেওয়ার কিছুদিন পরেই মুনাফার প্রথম ১০ হাজার টাকা পেয়ে যান মৌসুমী। এরপর তার বিশ্বাস জন্মে যায় ওই প্রতিষ্ঠানে ‘সেবা কার্ড’ করলে সত্যি টাকা ১০ গুণ হয়ে যায়।
এই বিশ্বাসেই মৌসুমী তার নামে ওই প্রতিষ্ঠানে আরও একাধিক কার্ড করেন। এরপর এমন লোভনীয় সুযোগের কথা জানিয়ে দেন প্রতিবেশী এবং নিকট আত্মীয়-স্বজনদেরও। ফলে তার মাধ্যমে আরও বহু নারী ওই প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন অঙ্কের টাকা জমা দিয়ে সেই সেবা কার্ড নেন।
তাদের কাছে বিভিন্ন ধরনের কার্ডের অফার ছিল। যেমন, বিধবা কার্ড, বয়স্ক কার্ড, অন্তঃসত্ত্বা কার্ড,অসুস্থতা কার্ড, শিশু কার্ড ও রেশন কার্ড। সব কার্ডধারীদেরকেই তাদের জমা করা টাকার ১০ গুণ ফেরত দেওয়া হবে বলে আশ্বাস দেয় ওই প্রতিষ্ঠান।
এভাবেই ওই প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন বয়সী নারীরা নগদ টাকা জমা দিয়ে ‘সেবা কার্ড’ গ্রহণ করেছেন। সব মিলিয়ে প্রায় ৪০০ শতাধিক নারীকে তারা কার্ড দিয়েছিল।
কার্ড করার পরে অনেক নারীদের সামান্য কিছু মুনাফার টাকা দেয়। তাদের মাধ্যমে আরও নারীদের সদস্য বানিয়েছে ওই প্রতিষ্ঠানটি। গত ২০ ফেব্রুয়ারির পর থেকে হঠাৎ পাল্টে যায় ১০ গুণ টাকা দেওয়া প্রতিষ্ঠানটি। কারও টাকাই ফেরত দিচ্ছিল না তারা। এরপর সুযোগ বুঝে অফিস গুছিয়ে পালিয়ে যায় তারা। ফলে অসহায় হয়ে পড়েন তাদের কাছে কার্ড করা ৪০০ নারী।
এ ঘটনায় গত ২৫ ফেব্রুয়ারি কদমতলী থানায় একটি মামলা দায়ের করেছন সংশ্লিষ্ট ভুক্তভোগী। সেই মামলার এজাহার, পুলিশ ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
ভুক্তভোগী একাধিক নারী জানান, মূলত সূর্যের হাসি ক্লিনিক নাম দিয়ে ওই প্রতিষ্ঠান তাদের কাজ শুরু করেছিল। তবে অফিসে ছিল না কোনো সাইনবোর্ড। পরে তারা জানতে পারে যে, ওই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ‘সূর্যের হাসি ক্লিনিকের’ কোনো সম্পর্কই নেই। একটি চক্র অসহায় নারীদের কাছে থেকে টাকা হাতিয়ে নিতে এমন ফাঁদ পেতেছিল। আর এই কাজে তাদের মূল সহায়তাকারী ছিলেন স্থানীয় শিরিন বকুল নামের এক নারী। এই শিরিন বকুলই বহু নারীর কাছে থেকে টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। ঘটনার পরে থেকেই পলাতক তিনি।
কদমতলী থানায় দায়ের করা মামলার প্রধান আসামিও হলেন শিরিন বকুল। তার নিজ বাসায় বসেই এসব কার্ডের টাকা জমা নিতেন। এই ঘটনার পরে তার বাসায় ভুক্তভোগী নারীরা টাকা ফেরত চাইতে গেলে তাদের লাঞ্চিত এবং মারধোর করেছেন বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীদের।
বিদেশি ফান্ডের টাকার ফাঁদ
এই চক্রের প্রতারণা শিকার হওয়া ভুক্তভোগী মৌ বলেন, ‘শিরিন বকুলের সাথে আমার ৯৫ হাজার টাকা লেনদেন হয়েছে। এর বাইরেও আমার অনেক আত্মীয়-স্বজনের কাছে থেকে টাকা নিয়েছে শিরিন৷’
তিনি বলেন, ‘শিরিন জানুয়ারি মাসে সবার কাছে থেকে টাকা দেওয়ার নাম করে বইগুলো নিয়া নিছে। বলেছে বিদেশ থেকে মালিক আসবে,এটা নাকি বিদেশি ফান্ডের টাকা৷ সূর্যের হাসি ক্লিনিকের নামে নাকি টাকাগুলো আসবে। মালিক আসবে তারে নাকি বইগুলো দেখাতে হবে। এরপর নাকি সকলকেই টাকা দিয়ে দেবে।’
ভুক্তভোগী ওই নারী আরও বলেন, ‘এই কার্ডগুলো দিয়ে তারা শুরুর দিকে প্রথমে কিছু কিছু মানুষকে টাকা দিয়েছে। এরপরই তারা বিশ্বাস অর্জন করেছে। আর পরে সর্বনাশ করে পালিয়ে গেছে।’
প্রতারণার ফাঁদে আরও যারা
পলাতক শিরিন বকুলের কথিত সেবা কার্ড নিয়ে প্রতারিত হয়েছেন আরও অনেক নারী। তাদেরই একজন জুলেখা (ছদ্মনাম)। তিনি একজন বিধবা। অন্যের বাসায় কাজ করে নিজের জীবন চালান। তিনিও কষ্টের টাকা জমা দিয়ে নিয়েছেন সেবা কার্ড। অন্যদের উদ্ভুত করে তাদেরও টাকা এনে শিরিন বকুলের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। এখন টাকা চাইতে গেলে তাকেই নাকি চেনন না শিরিন।
ওই নারী আরও বলেন, ‘অনেকের কাছে থেকে কার্ড করার নামে টাকা শিরিন বকুলকে টাকা এনে দিছি। এখন শিরিন বকুল নাকি আমারে চেনে না।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক প্রবাসীর স্ত্রী জানান, তিনিও ৫ হাজার টাকার ২ টা কার্ড করেছিলেন৷ কিন্তু বেশি বিপদে পড়েছেন আরও ১০/১২ জনের কার্ড করে দিয়েছেন তিনি। তাদের মধ্যে তার শাশুড়ি এবং জা-এর টাকাও রয়েছে। এসবের কারণে উল্টো সংসারটাই ভাঙতে বসেছে তার। টাকা চাইতে গেলে কিছু নারীদের লাঞ্চিত এবং মারধর করেন শিরিন বকুল এবং তার ছেলে সেই মারধরোর একটা ভিডিও করেছেন।
তবে এতজন নারীর মধ্যে একজন পুরুষ রয়েছেন যিনিও শিরিনের প্রতারণার শিকার। তার নাম আব্দুল মজিদ। তিনি পেশায় একজন আচার ব্যবসায়ী। অসুস্থতার নামের কার্ড নিয়ে প্রতারণার শিকার হয়েছেন মজিদ। তিনি বলেন, ‘শিরিন বকুলই সব কিছুর মুল হোতা। আমি নিজের এবং অন্যের মিলে মোট ৫ লাখ টাকা দিছি। এখন সেই পাওনাদারেরা এসে আমাকেই টাকার জন্য চাপ দিচ্ছেন।’
ভুক্তভোগী এক নারী যখন আসামি
এই প্রতারণার ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলায় আলপনা নামের অপর এক নারীকেও আসামি করা হয়েছে। কিন্তু আলপনা নিজেই নাকি একজন ভুক্তভোগী। এমনকি শিরিনের নামে তিনি নিজেই মামলা করতে চেয়েছিলেন বলে জানান অন্য ভুক্তভোগীরা।
এই বিষয়ে জানতে চাইলে আলপনা বলেন, ‘আমার মা এক সময় শিরিন বকুলের বাসায় কাজ করতো। সেই থেকেই তার সাথে পরিচয়। এরপর আমার বাচ্চা হওয়ার পর শিরিন বকুল আমায় দেখতে এসেছিল। তখন সে প্রথম বলে, “তোমায় ৫ হাজার টাকার একটা কার্ড করে দিবো, তুমি এই এই সুযোগ সুবিধা পাবে”।’
তিনি আরও বলেন, ‘তাদের কথা মতো মত তিন মাস পরেই আমারে ৫০ হাজার টাকা দিছে, এটা দিয়েই আমারে বিশ্বাস করাইছে। এরপর আমি তাদের সদস্য জোগাড় করে দিছি ১০ জনের কার্ড করালে তারা আমারে ২ হাজার টাকা দিতো। এভাবেই ৪০০ জন সদস্য হইছে। এখন তারা পালাইছে উল্টো সব নারীরা এখন আমারে টাকার জন্য চাপ দিচ্ছে। আমি নিজেও থানায় মামলা করতে গিয়েছিলাম। ’
যেভাবে টাকা ১০ গুণ হতো সেবা কার্ডে
প্রতারিত ও ভুক্তভোগীদের দেওয়া তথ্যমতে, প্রতারক চক্রের সদস্যরা জানিয়ে ছিল যে, প্রতি সাধারণ সেবা কার্ডে ৫ হাজার টাক জমা করলে ৬ মাস পরে ৫০ হাজার টাকা দিবে তারা। আর ১০ হাজার টাকার অসুস্থ কার্ডে এক বছর পরে এক লাখ টাকা দিবে। অসুস্থতার কার্ডটা তারা ফেব্রুয়ারির ১ তারিখ থেকে নেওয়া শুরু করেছিল।
তারা নিয়মে আরও বলেছে, রেশন কার্ডের নামে ৫ হাজার টাকা দিলে এক মাস পর পর ২ হাজার ৫০০ টাকার চাল ডাল দিবে। বলছে এটা দেড় দুই বছর পর্যন্ত দিবে। অসুস্থ কার্ড করে ১০ হাজার টাকা জমা দিলে এক বছর পরে তারা এক লাখ টাকা দিবে। আর সারা বছর চিকিৎসা বিনামূল্যে। আর বিধবা কার্ডের কথা বলছে, ৫ হাজার টাকা জমা দিলে প্রতি মাসে ২ হাজার টাকা করে দিবে। শিশু কার্ডে ৫ হাজার টাকা জমা দিলে ২ মাস পর পর ৫ হাজার টাকা করে দিবে।
এছাড়া, পঙ্গু ভাতার কার্ড করে ৫ হাজার টাকা জমা দিলে মাসে মাসে ২ হাজার করে দিবে। এভাবেই বিভিন্ন কার্ডের নাম বলে ৪০০ মানুষের কাছে থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে প্রতারক চক্রটি।
শিরিনকে গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে
এই ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা কদমতলী থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) লালবর রহমান বলেন, ‘মামলার প্রধান আসামি পলাতক রয়েছেন। তাকে গ্রেপ্তারের জন্য অভিযান চালানো হচ্ছে। তথ্য-প্রযুক্তির মাধ্যমে লোকেশন সনাক্ত করে খুব দ্রুতই তাকে গ্রেপ্তার করা হবে। ’
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে প্রধান আসামি ও অভিযুক্ত শিরিন বকুলের মোবাইলে একাধিক বার ফোন করা হলেও নাম্বারটি বন্ধ পাওয়া গেছে।