আন্তর্জাতিক

কোভিড: এক সপ্তাহে ৯০% মানুষকে টিকা দিয়ে অনন্য কীর্তি ভুটানের


Warning: strlen() expects parameter 1 to be string, array given in /home/khalinews/public_html/wp-includes/functions.php on line 262
(Last Updated On: )

করোনাভাইরাসের মহামারীতে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর যখন হিমশিম অবস্থা, তখন মোট প্রাপ্তবয়স্ক জনসংখ্যার ৯০ শতাংশকে টিকা দিয়ে ‘আশার আলো জ্বেলেছে’ হিমালয়ের কোলের ছোট্ট দেশ ভুটান।

সিএনএন এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০ জুলাই করোনাভাইরাসের টিকার দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া শুরু করে মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে ৯০ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকের টিকার কোর্স শেষ করেছে ভুটান, যাকে একটি ‘অনন্য কীর্তি’ হিসেবে বর্ণনা করেছে জাতিসংঘের সংস্থা ইউনিসেফ।

ভারত এবং চীনের মাঝামাঝি ছোট্ট এই দেশটিতে উঁচু হিমালয়ের ঢালে বাস করে ৭৭ হাজার মানুষ। উচ্চতার পাশাপাশি প্রত্যন্ত পাহাড়ি গ্রামে পৌঁছানোর দুর্গম পথ, পশুপালক যাযাবর জনগোষ্ঠী এবং বিরূপ আবহাওয়া- সব মিলে সারা দেশে টিকা পৌঁছানো ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। 

গত ২০ জুলাই টিকার দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া শুরু হলেও প্রচারসহ এর প্রস্তুতি চলছিল কয়েক মাস ধরে। প্রত্যন্ত যেসব স্বাস্থ্য ক্লিনিকে পৌঁছানো কষ্টকর, সেসব জায়গায় টিকা পরিবহনের সময় কোল্ড চেইনের ব্যবস্থাও করতে হয়েছে।

যেসব এলাকা আরও বেশি দুর্গম, সেখানে টিকা পাঠানোর জন্য হেলিকপ্টারের ব্যবস্থা করেছে ভুটান। পায়ে হাঁটা পাহাড়ি পথে ঘুরে ঘুরে লোকজনকে টিকা দিয়েছেন একদল স্বেচ্ছাসেবী।

দেশটিতে টিকা পাওয়ার যোগ্য মোট ৫ লাখ ৩০ হাজার মানুষের মধ্যে ৪ লাখ ৮০ হাজার জনকে বুধবার পর্যন্ত টিকা দেওয়া শেষ হয়েছে বলে জানিয়েছে সিএনএন।

রাজধানী থিম্পুতে ইউনিসেফের ভুটান প্রতিনিধি উইল পার্কস বলেন, “মহামারীর মধ্যে এটাই ছিল সবচেয়ে বেশি দ্রততার সঙ্গে সম্পন্ন করা টিকাদান কর্মসূচি।”

ভারতের কাছ থেকে উপহার পাওয়া প্রায় ৫ লাখ ডোজ অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা নিয়ে গত মার্চ মাসে গণ টিকাদান কর্মসূচি শুরু করে ভুটান।

কিন্তু মহামারীর দ্বিতীয় ঢেউয়ে করোনাভাইরাসের অতি সংক্রামক ডেল্টা ধরনে পর্যুদস্ত ভারত টিকা রপ্তানি বন্ধ করে দিলে অন্যান্য উৎস থেকে টিকা সংগ্রহের চেষ্টা শুরু করে দেশটি।

এসময় ভুটানের আহ্বানে সাড়া দেয় বেশ কিছু দেশ। ইতোমধ্যে বিশ্বজুড়ে টিকা সরবরাহ নিশ্চিত করার আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্ম কোভ্যাক্সের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে মডার্নার ৫ লাখ ডোজ টিকা সংগ্রহ করেছে ভুটান।

এছাড়া অ্যাস্ট্রাজেনেকার ২ লাখ ৫০ হাজার ডোজ টিকা দিয়েছে ডেনমার্ক। এর আগে চীন দিয়েছিল সিনোফার্মের টিকার ৫০ হাজার ডোজ। ক্রোয়েশিয়া, বুলগেরিয়াসহ আরও কিছু দেশ থেকে আসছে অ্যাস্ট্রাজেনেকার ১ লাখের বেশি টিকা। 

সবচেয়ে বেশি টিকা প্রয়োজন এমন দেশের জন্য যেসব দেশে বাড়তি টিকা আছে, তারা এক হয়ে টিকা সরবরাহ করার এমন উদ্যোগ আন্তর্জাতিকভাবেও প্রশংসা কুড়িয়েছে। 

ইউনিসেফ প্রতিনিধি পার্কস বলেন, “আমরা দেখছি টিকার জন্য দেশগুলো একে অন্যের সঙ্গে লড়ছে, এর মধ্যেই যখন আমরা দেখি যে টিকা না থাকা দেশগুলোর জরুরি প্রয়োজনে অনেক দেশের সরকার সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে, তখন মনটা ভরে যায়।”  

তার ভাষায়, “এই ঘটনা এমন এক বৈশ্বিক সংহতির গল্প বলছে, যা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেখা যায়নি। এখন আমরা সেই সংহতি দেখতে পাচ্ছি, বহুপাক্ষিকতা আবার ফিরে আসছে। বিশ্বের এই সংকটের সময় এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।” 

ইউনিসেফ বলছে, অতিরিক্ত টিকা যেসব দেশের হাতে আছে, তাদের উচিত টিকার সঙ্কটে থাকা দেশগুলোর প্রতি সহায়হার হাত বাড়িয়ে দেওয়া, ভুটানের সফলতার গল্প সে কথাই বলছে।

কোভিড মহামারীতে টিকা দিয়ে কিংবা হিমায়িত করার সরঞ্জাম, পরিকল্পনা এবং প্রশিক্ষণসহ নানা ধরনের রসদ যুগিয়ে সহায়তা করে যাচ্ছে জাতিসংঘের বিশেষায়িত সংস্থা ইউনিসেফ।

টিকার রসদ

ভুটানে ১৮ বছর পেরোনো সব নাগরিককেই টিকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এর মধ্যে মডার্না এবং অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার যে কোনো একটি বেছে নেওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন নাগরিকরা।

ইউনিসেফ প্রতিনিধি পার্কস জানান, ভারত সীমান্তের লাগোয়া ভুটানের দুটি জেলায় লকডাউনের মধ্যে সম্প্রতি ১২ থেকে ১৭ বছর বয়সীদের মধ্যে ফাইজারের টিকাও দেওয়া হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের ওষুধ কোম্পানি ফাইজারের কাছ থেকে আরও ২ লাখ ডোজ টিকা কেনার চুক্তি করেছে ভুটান সরকার। এ বছরের শেষ দিকে ওই টিকা পৌঁছানোর কথা, যা শিশুদের দিতে চায় দেশটি।

কিন্তু দুর্গম এই দেশে এত অল্প সময়ে সাধারণ মানুষের কাছে নিরাপদে টিকা পৌঁছে দিতে ভুটানের স্বাস্থ্যকর্মীদের যা করতে হয়েছে, তা এক কথায় অনন্য। ২২ হাজার স্বেচ্ছাসেবী এবং ২ হাজার চারশর বেশি চিকিৎসাকর্মী এ কাজ সফল করতে মানুষের দ্বারে দ্বারে গেছেন।

দুর্গম কেন্দ্রগুলোত টিকার ডোজ পৌঁছে দিতে স্বেচ্ছাসেবীদের হেলিকপ্টার থেকে টিকা সংগ্রহ করে পায়ে হেঁটে বিভিন্ন এলাকায় যেতে হয়েছে। এবং এর পুরো সময় তাদের নিশ্চিত করতে হয়েছে যেন টিকাগুলো সঠিক তাপমাত্রায় থাকে।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে উড়োজাহাজে করে ভুটানে টিকা নিয়ে যাওয়াটাও ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। ভুটানের একমাত্র আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ‘পারো’ বিশ্বের অন্যতম বিপজ্জনক বিমানবন্দর। হিমালয়ের চূড়ার পাশ দিয়ে খাড়া নেমে এসে খুবই স্বল্প দৈর্ঘ্যের একটি রানওয়েতে উড়োজাহাজ থামাতে হয় সেখানে। এ বিমানবন্দরে বিমান নামানোর অনুমতি আছে এমন পাইলটের সংখ্যা ২০ জনেরও কম।

একজন ইন্দোনেশীয় বৈমানিক একটি ভাড়া করা ফ্লাইটে যুক্তরাষ্ট্রের কেনটাকি থেকে মডার্নার তৈরি ৫ লাখ ডোজ টিকা নিয়ে এসেছিলেন ভুটানের জন্য। কিন্তু ভুটানে নামতে না পারায় তিনি সেই চালান নিয়ে যান কলকাতায়।

ইউনিসেফ প্রতিনিধি পার্কস জানান, একজন ভুটানি পাইলটকে ওই ফ্লাইট ধরার জন্য কলকাতায় পাঠাতে হয়। পরে তিনি ওই ফ্লাইট উড়িয়ে পারোতে নিয়ে আসেন।

সফলতা আছে আরও

দারিদ্র্য দূরীকরণে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভুটান বেশ অনেকটাই এগিয়েছে। বিশ্ব ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, ২০০৭ সালে দেশটিতে দারিদ্র্যের হার যেখানে ৩৬ শতাংশ ছিল, ২০১৭ সালে তা ১২ শতাংশে নেমে এসেছে।

ভুটানের গ্রামীণ জনসংখ্যার বড় অংশ কৃষিকাজে জড়িত থাকলেও উন্নয়ন থেমে থাকেনি। অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রধান উৎস হয়ে উঠেছে জলবিদ্যুৎ, যার মাধ্যমে শিক্ষা এবং পানি সরবরাহ ব্যবস্থাসহ সামাজিক সেবায় অর্থায়ন হয়েছে।

বিশ্ববাসীর কাছে ভুটান সবচেয়ে বেশি পরিচিত ‘সুখী দেশ’ হিসেবে। জীবনযাত্রা, উন্নয়ন, শিক্ষা এবং শাসনব্যবস্থার ওপর ভিত্তি করে করে সুখী দেশের এই সূচক তৈরি করা হয়েছে।

কোভিড মোকাবিলার ক্ষেত্রেও সবচেয়ে বেশি সফলতার পরিচয় দিয়েছে এই হিমালয় রাজ্য। মহামারী ঠেকাতে আগাম পরিকল্পনার পাশাপাশি সংক্রমণের শুরুর দিকেই দ্রুততার সঙ্গে সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছিল ভুটান।

এছাড়া গণহারে পরীক্ষার মাধ্যমে সংক্রমণ শনাক্ত করা, কোয়ারেন্টিন, সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা এবং কঠোর লকডাউনের মাধ্যমে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছে তারা। 

মাত্র ৩০০ জন চিকিৎসকের এই দেশটি মহামারী মোকাবিলায় তাদের স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে। কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করা হয়েছ ‘কোভিড রেসপন্স প্ল্যান’।

ভুটানে এ পর্যন্ত মোট ২ হাজার ৪৮৯ জনের কোভিড- ১৯ শনাক্ত হয়েছে এবং গত জানুয়ারিতে প্রথমবারের মত দুজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শক্ত নেতৃত্বের কারণে সাধারণ মানুষের চিকিৎসায় যথাসময়ে ব্যবস্থা নেওয়া গেছে এবং মানুষের মাঝে প্রচারও চালানো হয়েছে।

ভুটান সরকারের শীর্ষ তিন নেতা প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিং, স্বাস্থ্যমন্ত্রী দাশো দেকেন ওয়াংমে এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী টান্দি দরজি আগে ছিলেন পেশায় চিকিৎসা এবং স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ।

বাংলাদেশের ময়মনসিংহ মেডিকেল থেকে এমবিবিএস করা লোটে শেরিং টিকাদান কর্মসূচির শুরুর দিকে নিজের ফেইসবুকে পেইজে নিয়মিত পোস্ট কিংবা ভিডিও দিয়েছেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় সাধারণ মানুষের প্রশ্নের জবাব দিয়ে টিকার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছেন।

মহামারীতে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছেন ভুটানের রাজা জিগমে খেসার নামগিয়েল ওয়াংচুক। টিকা নিয়ে মানুষের মাঝে সচেতনতা বাড়াতে গ্রাম থেকে গ্রামে ছুটে বেরিয়েছেন ৪১ বছর বয়সী এই রাজা।

বজ্র ড্রাগনের দেশ ভুটান বৌদ্ধ অধ্যুষিত। ২০০৮ সালে ছেলে নামগিয়েল ওয়াংচুকের হাতে ক্ষমতা তুলে দেওয়ার মাধ্যমে ভুটানকে নিখাঁদ রাজতন্ত্র থেকে সাংবিধানিক রাজতন্ত্রের পথে তুলে দেন দেশটির রাজা জিগমে সিঙিয়ে ওয়াংচুক।

করোনাভাইরাসের ডেল্টা ধরনে বিপজ্জনক মাত্রার সংক্রণের মধ্যে টিকা দেওয়ার ক্ষেত্রে এই সফলতা ভুটনকে দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যেও একটি অনন্য অবস্থানে নিয়ে গেল।