জাতীয়

ডাকাতির টাকায় জঙ্গিদের ‘হালাল ও ফ্রেশ’ ব্যবসা

(Last Updated On: মে ৯, ২০২১)

জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি), হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশ এবং আনসার আল ইসলাম- তিন সংগঠনের আদর্শ প্রায় একই। বিভিন্ন সময় গ্রেপ্তার হয়ে কারাবন্দি আছেন এ জঙ্গি সংগঠনের বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতা। এর পরও বন্ধ নেই তাদের মিশন। জেলে বসেই তারা শুরু করেন অভিন্ন পরিকল্পনা। ভার্চুয়াল মাধ্যমে নির্দেশনা দেন কারাগারের বাইরে থাকা অনুসারীদের।

আর সেই পরিকল্পনা অনুসারে পেশাদার ডাকাত দলের সঙ্গে মিশে যায় জঙ্গিরা। ডাকাতির অর্থের একটি অংশ চলে যেত কারান্তরীণ শীর্ষ জঙ্গি নেতাদের কাছে। সেই টাকায় গড়ে তোলা হয় ‘হালাল ও ফ্রেশ’ নামে একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানও। আর বাকি অংশ ব্যয় করা হতো সংগঠনের কথিত দাওয়াতি কার্যক্রমে। এদিকে কারাবন্দি জঙ্গি নেতাদের কাছে অর্থের বিনিময়ে ইন্টারনেট সংযোগসহ ইলেকট্রনিক্স ডিভাইস এবং ডাকাতির অর্থ পৌঁছে দিত কিছু অসাধু কারারক্ষী। এমনই ভয়ঙ্কর তথ্য উঠে এসেছে গোয়েন্দাদের অনুসন্ধানে। এরই মধ্যে এসব শীর্ষ জঙ্গি নেতাদের শোন অ্যারেস্ট দেখিয়ে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) তেজগাঁও বিভাগ। তারা হলেন- জেএমবির শীর্ষ জঙ্গিনেতা নাহিদ তাসনিম ও আনসার আল ইসলামের আল আমিন।

পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, কারাগারে জঙ্গিদের সহযোগিতাকারীদের বিষয়ে কারা কর্তৃপক্ষকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানাতে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে পুলিশের পক্ষ থেকে। সেই সঙ্গে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের কর্মকর্তারাও কারাবন্দি জঙ্গিনেতাদের বিষয়ে খোঁজ নেওয়া শুরু করেছেন। গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, প্রায় এক মাস আগে রাজধানীর পূর্ব তেজতুরীপাড়া এলাকায় ডাকাতির সঙ্গে জড়িত আসিফুর রহমান আসিফ ও পিয়াস শেখ নামে দুই জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করে

ডিবি পুলিশ। তাদের জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে তিন সংগঠনের চার শীর্ষ নেতার যোগসাজশে ভয়ঙ্কর পরিকল্পনার কথা। তাদের মধ্যে জেএমবির অন্যতম শীর্ষ নেতা নাহিদ তাসনিম এবং মাওলানা আবু সাঈদ দীর্ঘদিন ধরেই কারাবন্দি। ২০১০ সালে জেএমবির আমির মাওলানা সাইদুর রহমান গ্রেপ্তার হওয়ার পর ভারপ্রাপ্ত আমিরের দায়িত্ব পায় তাসনিম। আবু সাঈদ ২০০৫ সালে সারাদেশে সিরিজ বোমা হামলা মামলার মৃত্যুদ-প্রাপ্ত আসামি। অন্য দুই শীর্ষ জঙ্গি নেতার একজন আল-আমিন আনসার আল ইসলামের নেতা ও অপরজন ফয়সাল হরকাতুল জিহাদ নেতা। এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘দুই জঙ্গিকে গ্রেপ্তারের পর জিজ্ঞাসাবাদে অনেক তথ্য পাওয়া গেছে। কারাবন্দি শীর্ষ নেতাদের নির্দেশনায় তারা ডাকাতি করছিল। এ বিষয়ে কারাবন্দি শীর্ষ নেতাদের শোন এরেস্ট দেখিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।’

গোয়েন্দারা জানান, কারাগার থেকে জঙ্গি নেতারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সরকারি কর্মকর্তা ও ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের বাসায় ডাকাতির নির্দেশ দিয়েছিল। কারণ এসব ব্যক্তিদের তারা ‘তাগুদ’ হিসেবে অভিহিত করে। তাদের বাসায় ডাকাতি করা অন্যায় হবে না বলেই তাদের ‘ফতোয়া’। আর এ নির্দেশনা মেনে জঙ্গিদের একটি গ্রুপ পেশাদার ডাকাত সদস্যদের সঙ্গে মিশে ডাকাতি শুরু করে। গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত রাজধানীর হাতিরঝিল, তেজগাঁও থানাধীন এলাকায় ছয়টি ডাকাতির ঘটনায় পেশাদার ডাকাত দলের সঙ্গে জঙ্গি সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। গ্রেপ্তার আসিফের মোবাইল ফোনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিভিন্ন অ্যাপ ঘেঁটেও কিছু তথ্য পাওয়া গেছে। কারাবন্দি শীর্ষ জঙ্গি নেতারা তাদের বার্তা পাঠিয়েছিল। গ্রেপ্তার আসিফের কাছ থেকে ২০ হাজার ও ১৫ হাজার করে দুভাগে ভাগ করে দুটি প্যাকেটও পাওয়া যায়। প্যাকেটের ওপর ‘তাসনিম নাহিদ ও আল-আমিন, কাশিমপুর’ লেখা ছিল। ডাকাতি করা এসব টাকা কারাবন্দি দুই জঙ্গি নেতার কাছে পাঠানোর পরিকল্পনা ছিল তাদের। আসিফ এর আগেও ডাকাতি করা অর্থ কারাগারে থাকা শীর্ষ নেতাদের পাঠিয়েছে বলে জানায়।

জঙ্গিবাদ দমনে নিয়োজিত এন্টি টেররিজম ইউনিটের (এটিউ) অতিরিক্ত ডিআইজি মো. মনিরুজ্জামান আমাদের সময়কে বলেন, ‘আমরা দেখতে পাচ্ছি, ফান্ড সংকটের কারণে জঙ্গিদের একটি অংশ বিশেষ করে জেএমবি সদস্যরা ডাকাতিকে জায়েজ ফতোয়া দিচ্ছে। এভাবে তারা ডাকাতির টাকায় অন্যান্য ব্যবসাও গড়ে তুলেছে। সারা দেশ থেকে এ চক্রের বেশ কিছু সদস্যকে এর আগে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। বিষয়টি নিয়ে আমরা কাজ করছি।’

জঙ্গি দমনের সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তারা জানান, আবু সাঈদ ২০০৫ সালে সারাদেশে সিরিজ বোমা হামলা মামলার মৃত্যুদ-প্রাপ্ত আসামি। ২০০৭ সালে ভারতে পালিয়ে যান তিনি। সেখানে নদীয়া, বীরভূম ও বর্ধমান জেলার জেএমবি কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৪ সালে বর্ধমানের খাগড়াগড় বিস্ফোরণে তার সম্পৃক্ততা পায় ভারতের ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি (এনআইএ)। তাকে ধরতে এনআইএ ১০ লাখ রূপি পুরস্কার ঘোষণাও করেছিল। ২০১৫ সালে আবু সাঈদ দেশে ফিরে আসে। ২০১৭ সালের ২৯ ডিসেম্বর বগুড়া জেলা পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে। পশ্চিমবঙ্গের পুলিশের খাতায় তার নাম শ্যামল শেখ। আবদুল্লাহ আল তাসনিম ওরফে নাহিদ পুরনো জেএমবির অন্যতম শীর্ষ নেতা। ২০১৪ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের হাতে তাসনিম ছয় সহযোগীসহ গ্রেপ্তার হন।