জাতীয়

শহীদুলকে স্ত্রী ত্যাগের পরামর্শ দিয়েছিলেন মামুনুল হক

(Last Updated On: এপ্রিল ৭, ২০২১)

নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ের রয়েল রিসোর্টের দ্বিতীয় স্ত্রীসহ অবরুদ্ধের পর থেকে আলোচনায় হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব ও ঢাকা মহানগরীর সাধারণ সম্পাদক মামুনুল হক। এবার বন্ধুত্ব ও বিয়ে ভাঙা নিয়ে কথা বলেছেন তার কথিত দ্বিতীয় স্ত্রীর প্রথম স্বামী হাফেজ শহীদুল ইসলাম। মামুনুলের সঙ্গে তার প্রথম স্ত্রী জান্নাত আরার বিয়ে সম্পর্কে তার জানা ছিলো না। তাই শনিবারের ঘটনার আগ পর্যন্ত মামুনুলের সঙ্গে তার সম্পর্ক অটুট ছিলো।

মামুনুল নিজেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া বক্তব্যে স্বীকার করেন একজন অসহায় নারী হিসেবে বন্ধু হাফেজ শহীদুলের স্ত্রী তার সহযোগিতা চান। তিনি ‘মানবিক কারণে’ তার অভিভাকত্ব গ্রহণ করেন।

এদিকে গত ২৬ মার্চ বায়তুল মোকাররম এলাকায় সহিংতার ঘটনায় সোমবার রাতে পল্টন থানায় মামলা হওয়ার পর মামুনুলকে গ্রেপ্তার করা হবে কি না জানতে চাইলে পুলিশের দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, মামলা হয়েছে। তদন্তে অপরাধের প্রমাণ পেলে গ্রেপ্তার করা হবে।

ওদিকে সোনারগাঁয়ে গত শনিবার (৩ এপ্রিল) মামুনুল ও তার কথিত দ্বিতীয় স্ত্রীকে লাঞ্ছিত করার প্রতিবাদ জানিয়েছে হেফাজতে ইসলাম। এক বিবৃতিতে এই ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের শাস্তি দাবির পাশাপাশি সারাদেশে নেতাকর্মীদের মুক্তি দাবি ও আগামী বৃহস্পতিবার মুন্সীগঞ্জের সিরাজদীখান থানার কুচিয়ামোড়ায় বিক্ষোভ সমাবেশ ডাক দিয়েছে হেফাজতে ইসলাম।

খুলনার স্থানীয় এক সাংবাদিককে হাফেজ শহীদুল জানান, বর্তমানে খুলনার সোনাডাঙ্গা থানার গোবরচাকা এলাকার শাহীনুর মসজিদের সামনে একটি বাসায় ভাড়া থাকেন। আর চাকরি করেন খুলনার খানজাহান আলী এলাকায় তালিমুল মিল্লাত মাদ্রাসার অন্তর্ভুক্ত জরিনা বেগম হাফেজী মাদ্রাসার প্রধান হাফেজ বা প্রধান শিক্ষক হিসেবে। তিন বছর আগে ফরিদপুর জেলার আলফাডাঙ্গা থানার কামারগ্রামের মুক্তিযোদ্ধা ওয়ালিউর রহমান ওরফে ওলি মিয়ার মেয়ে জান্নাত আরা ঝর্ণার সঙ্গে তার ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। এরপর তিনি (হাফেজ শহীদ) দ্বিতীয় বিয়ে করেন বাগেরহাটের চিতলমারী থানা এলাকায়। ওই স্ত্রীকে নিয়ে ভাড়া থাকেন খুলনার গোবরচাকা এলাকায়। দ্বিতীয় স্ত্রীর ঘরে তার এক বছর বয়সী একটি ছেলে আছে। প্রথম স্ত্রীর দুই ছেলে।

হাফেজ শহীদ বলেন, ‘প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে সুখেই সংসার চলছিল। আল্লামা মামুনুল হকের মামার বাড়ি আর আমার বাড়ি একই উপজেলায়। সেই সুবাদে তার সঙ্গে আগে থেকেই পরিচয় হয়। সেই পরিচয় আরো গাঢ় ও ঘনিষ্ঠতায় রূপ নেয় রাজনীতি করতে গিয়ে। আমি খেলাফত মজলিশ করি। মামুনুল খেলাফত মজলিশের মহাসচিব। তিনি খুলনা অঞ্চলে সফরে এলে আমি তার সঙ্গে থাকতাম। তিনি বহুবার একা বা সপরিবারে আমার বাসায় অতিথি হয়ে এসেছেন। আমি নিজেও সপরিবারে তার বাসায় বহুবার গিয়েছি। আমাদের বন্ধুত্ব অত্যন্ত গভীর। যাতায়াতের সুযোগে আমার স্ত্রী সন্তানদেরও তিনি চেনেন জানেন।’

হাফেজ শহীদ বলেন, ‘আবদুর রহমানের মা (জান্নাত আরা ঝর্ণা) হঠাৎ করে সৌদি আরব প্রবাসী এক ছেলের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথাবার্তা শুরু করে। ওই ছেলের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে বারণ করার পরও জান্নাত আরা বিষয়টিকে পাত্তা দেননি। এ নিয়ে আমাদের মধ্যে দাম্পত্য কলহ শুরু হয়। সেটা ৫-৬ বছর আগের কথা। পরে প্রবাসী ওই যুবক আমার প্রথম স্ত্রীকে তার প্রেমের ফাঁদে ফেলে। এ নিয়ে দাম্পত্য কলহের এক পর্যায়ে মামুনুলও বিষয়টি অবগত হন। তিনি আমাকে নতুন করে সংসার শুরুর পরামর্শ দেন। বছর তিনেক আগে প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে তার ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। এরপর তিনি দ্বিতীয় বিয়ে করেন। খুলনার শেখপাড়া জামে মসজিদে হওয়া ওই বিয়ে মাওলানা মামুনুল নিজেই পড়িয়েছেন।’

হাফেজ শহীদুল জানান, তালাক দেওয়ার পর একজন নারী তার প্রথম স্বামীর জন্য ‘বেগানা নারী’ হিসেবে পরবর্তীকালে আর তার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেননি। তবে শুনেছেন প্রবাসী যে ছেলে তার প্রথম স্ত্রীকে বিয়ের আশ্বাস দিয়েছিল ওই ছেলে দেশে এসে বিয়ে করতে রাজি হয়নি। এরপর শুনেছেন তার তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রী ঢাকায় থাকেন। মামুনুলের সঙ্গে বিয়ের বিষয়টি তার জানা ছিলো না।

হাফেজ শহীদুলের বড় ছেলে হাফেজ আবদুর রহমান জানান, শনিবার মামুনুল নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে আটক হওয়ার পর দিন রোববার সকালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীবাহিনীর একটি দল সাদা পোশাকে তাদের খুলনার বাসায় যায়। সেখান থেকে আবদুর রহমান ও তার বাবাকে গাড়িতে করে ঢাকায় নিয়ে আসে। তাদের সেখানে রেখে নানা বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ওই লোকজনই তাকে সোমবার ভোরে খুলনার সোনাডাঙ্গা পৌঁছে দেয়। এর কিছু সময় পর তার বাবাকে মাওয়া ঘাটে পৌঁছে দেয় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকজন। ফলে তারা অজানা আতঙ্কের মধ্যে দিন পার করছেন। তাদের পুরো পরিবার এখনো পুলিশের নজরদারিতে আছে বলে দাবি করেন আবদুর রহমান।

তিনি আরো বলেন, ‘আমার মা-বাবার ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর মামুনুল সাহেব খুব খুশি ছিলেন। তিনি কুবুদ্ধি দিয়ে আমাদের সংসার ধ্বংস করেছেন। খারাপ হলেও তিনি আমার মা। আমি তার বিরুদ্ধে কিছু বলতে পারি না।’

মামলা প্রমাণ হলে গ্রেপ্তার- এদিকে বায়তুল মোকাররম মসজিদ এলাকায় গত ২৬ মার্চ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর দিনে হেফাজতের তাণ্ডবের ঘটনায় মামুনুল হকসহ ১৭ জনের বিরুদ্দে মামলা করেছেন যুবলীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের উপদপ্তর সম্পাদক খন্দকার আরিফ-উজ-জামান। মামলায় মামুনলকে তাণ্ডবের হুকুমদাতা হিসেবে ১ নম্বর আসামি করা হয়েছে।

তাদের গ্রেপ্তারের বিষয়ে জানতে চাইলে গতকাল ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মতিঝিল বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) সৈয়দ নুরুল ইসলাম বলেন, মামুনুলসহ হেফাজত নেতাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ তদন্তে প্রমাণিত হলে তাদের গ্রেপ্তার করা হবে। এজাহারে যাদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে তাদের অনেকের রাজনৈতিক পরিচয় রয়েছে। তবে আমরা কোনো পদ বিবেচনায় নেব না। আমরা অপরাধ বিবেচনায় নিয়ে অপরাধীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব। মামলাটি গতকাল (সোমবার) রাতে হয়েছে। এখনো প্রি-ম্যাচিউরড রয়েছে। আমরা আসামিদের প্রকৃত পরিচয়, তারা বর্তমানে কোথায় অবস্থান করছে, ২৬ তারিখ তারা কোথায় ছিল, বায়তুল মোকাররমে সরাসরি উপস্থিত ছিল কি না, তারা নাশকতার নির্দেশ-উসকানি দিয়েছে কি না, হামলার অর্থদাতা বা মাস্টারমাইন্ড কি না তা শনাক্ত করে তাদের গ্রেপ্তারসহ যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।’

মামুনুল হককে গ্রেপ্তার করা হবে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে ডিসি বলেন, ‘আমরা তদন্ত করব। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হবে তাদের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

মামুনুল ছাড়া মামলার অন্য ১৬ আসামি হলেন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা জুনায়েদ আল হাবিব, যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা লোকমান হাবিব, যুগ্ম মহাসচিব নাসির উদ্দিন মনির, নায়েবে আমির মাওলানা বাহাউদ্দিন জাকারিয়া, মাওলানা নুরুল ইসলাম জেহাদী, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নায়েবে আমির মাজেদুর রহমান, মাওলানা হাবিবুর রহমান, মাওলানা খালেদ সাইফুল্লাহ আইয়ুবী ও সহকারী মহাসচিব মাওলানা জসিম উদ্দিন।

হেনস্তাকারীদের শাস্তি দাবি হেফাজতের, এদিকে হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক ও তার কথিত স্ত্রীকে সোনারগাঁর রয়েল রিসোর্টে হেনস্তাকারীদের শাস্তির আওতায় আনার দাবি জানিয়েছে সংগঠনটির নেতারা। পাশাপাশি মামুনুলকে নিয়ে সংসদে দেওয়া বক্তব্য প্রত্যাহারের আহ্বান জানান তারা। এ ছাড়া হত্যা ও হামলা-মামলার প্রতিবাদে আগামী বৃহস্পতিবার মুন্সীগঞ্জের কুচিয়ামোড়া এলাকায় বিক্ষোভ সমাবেশের ডাক দেওয়া হয়েছে। গতকাল গণমাধ্যমে পাঠানো হেফাজতে ইসলামের এক বিজ্ঞপ্তিতে এসব কথা বলা হয়েছে।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, জামিয়া রাহমানিয়ায় হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় কমিটির শীর্ষ নেতৃবৃন্দের জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে নায়েবে আমির মাওলানা আব্দুল হামিদ পীর সাহেব মধুপুরী সভাপতিত্ব করেন।

বিজ্ঞপ্তিতে আরো বলা হয়, ‘মাওলানা মামুনুল হক (৩ এপ্রিল) তার স্ত্রীকে নিয়ে সোনারগাঁয়ে একটি রিসোর্টে গিয়েছিলেন। ইসলামী শরিয়তের আলোকে তার বিবাহ পরিপূর্ণ শুদ্ধ মর্মে আমরা নিশ্চিত হয়েছি। এ নিয়ে বিভ্রান্তির কোনো অবকাশ নেই। দেশের যেকোনো নাগরিক তার স্ত্রী-পরিবার নিয়ে যেকোনো স্থানে যাওয়ার অধিকার রাখেন।

কিন্তু মাওলানা মামুনুল হকের মতো পরিচিত ও সম্মানিত ব্যক্তির ওপর সন্ত্রাসীরা যেভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, আমরা তার তীব্র নিন্দা জ্ঞাপন করছি এবং অভিযুক্তদের বিচারের আওতায় আনার জোর দাবি জানাচ্ছি। জাতীয় সংসদে একজন নাগরিকের ব্যক্তিগত বিষয়কে যেভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, এটা জনগণ কখনোই আশা করেনি। আমরা এ বক্তব্য প্রত্যাহার করার আহ্বান জানাই।’

এছাড়া গত ২৬, ২৭, ২৮ মার্চ বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ, হাটহাজারী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, মুন্সীগঞ্জসহ সারা দেশে হেফাজতকর্মী ও প্রতিবাদী মানুষের ওপর হামলা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয় বিজ্ঞপ্তিতে। হামলায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও হাটহাজারীতে ২০ জন নিহত হয়েছে দাবি করে বলা হয়, এ ব্যাপারে তদন্তের মাধ্যমে দোষীদের শাস্তির আওতায় আনার দাবি জানাই। পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন স্থানে গ্রেপ্তার হওয়া হেফাজতকর্মীদের অবিলম্বে নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করছি।

বিজ্ঞপ্তিতে দাবি করা হয়, মুন্সীগঞ্জের সিরাজদীখানের মধুপুরে গত হরতালের দিনে হেফাজতে ইসলামের নায়েবে আমির মাওলানা আব্দুল হামিদ মধুপুরীকে গুলি করে আহত করা হয়েছে। তারপরও সেখানকার স্থানীয় জনগণকে বিভিন্নভাবে হুমকিধমকি দেওয়া হচ্ছে। আগামী বৃহস্পতিবার মুন্সীগঞ্জের কুচিয়ামোড়াতে হেফাজতে ইসলামের উদ্যোগে দেশব্যাপী হত্যা ও হামলা-মামলার প্রতিবাদে বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছে। এতে অংশ নিতে সবাইকে আহ্বান জানানো হয় বিজ্ঞপ্তিতে।