বন্ধু রোমানের মাধ্যমে সাত বছর আগে প্রশ্নফাঁসে জড়ান বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগের সদ্য বহিষ্কৃৃত সদস্য ও দুপচাঁচিয়া উপজেলা নারী ভাইস চেয়ারম্যান মাহবুবা নাসরীন রুপা। দুই বন্ধু প্রশ্নফাঁস করে নিয়োগ পরীক্ষায় বসতেন। ফাঁস হওয়া প্রশ্নে পরীক্ষা দিতে দিতেই একসময় নিজেরাই প্রশ্নফাঁসের হোতা বনে যান। এক সময় প্রশ্ন ফাঁস করে রেলওয়েতে চাকরি হয়ে যায় নারায়ণগঞ্জের ছেলে রোমানের। কিন্তু রুপা প্রশ্নফাঁসের পাশাপাশি রাজনীতি ও তদবির বাণিজ্যে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।
হঠাৎ করেই গত বছর সরকারি চাকরির জন্য হন্যে হয়ে ওঠেন রুপা। একের পর এক চাকরির পরীক্ষা দিতে থাকেন। ১৯৯১ সালে জন্ম নেওয়া রুপার সরকারি চাকরির বয়স শেষ হয়েছে মাসকয়েক আগে। প্রতিরক্ষা মহাহিসাব নিরীক্ষকের অডিটর পদে নিয়োগ পরীক্ষাই ছিল তার সরকারি চাকরির জন্য শেষ পরীক্ষা। তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এসব তথ্য জানিয়েছে।
প্রশ্নফাঁসের অভিযোগে গ্রেপ্তার ১০ জনকে দুদিনের রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে আজ মঙ্গলবার আদালতে তোলা হবে। তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মহাহিসাব নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ের (সিজিএ) বরখাস্ত কর্মকর্তা মাহমুদুল হাসান আজাদ, রুপা আর রোমান মিলে প্রশ্নফাঁসের একটি সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। চক্রটি দীর্ঘদিন ধরেই বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস করছিল। ডিভাইসের মাধ্যমে প্রশ্ন ফাঁসের পাশাপাশি তারা একজনের প্রবেশপত্রে অন্যজনকে পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার সুযোগ করে দিত। গত শুক্রবার অভিযানের সময় রোমানের ছোট ভাই রাজু আহমেদকে গ্রেপ্তার করা হয়। তিনিও দীর্ঘদিন ধরে এই চক্রের সদস্য। ঘটনার পর থেকে রোমানের মোবাইল নম্বর বন্ধ রয়েছে। তার অবস্থানের সম্ভাব্য সব জায়গায় অভিযান চালাচ্ছে পুলিশ।
হল থেকে প্রশ্নফাঁসের ক্ষেত্রে পরীক্ষাকেন্দ্রের শিক্ষক ও পিয়নরা জড়িত জানিয়ে একজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, পরীক্ষা শুরুর কয়েক মিনিট আগে কেন্দ্রের শিক্ষক একটি প্রশ্নপত্র পিয়নকে দেয়। সেই প্রশ্নের ছবি তুলে পিয়ন বাইরে চক্রের সদস্যদের কাছে পাঠিয়ে দেয়। চক্র দ্রæত প্রশ্নের সমাধান করে তাদের সঙ্গে চুক্তি হওয়া পরীক্ষার্থীদের একটি ডিভাইসে যুক্ত করে। এরপর তারা একটি করে প্রশ্নের উত্তর বলতে থাকে আর পরীক্ষার্থীরা কানে সংযুক্ত ছোট সেই ডিভাইসের মাধ্যমে শুনে শুনে উত্তর লেখে।
জানা গেছে, রুপা ইডেন কলেজ শাখা ছাত্রলীগের যুগ্ম আহŸায়ক ছিলেন। এরপর কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের একাধিক নেতার আশীর্বাদে বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য এবং ২০১৯ সালে দুপচাঁচিয়া উপজেলা নারী ভাইস চেয়ারম্যানের নমিনেশনও বাগিয়ে নেন। সরকারি দলের পরিচয় দিয়ে নির্বাচনে অংশ নিয়ে বেশ কয়েকজন নারী প্রার্থীকে হারিয়ে তিনি উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে চমকে দেন।
তদন্ত কর্মকর্তারা বলছেন, গ্রেপ্তার হওয়া আসামিরা আগেও বিভিন্ন ব্যাংক, অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন অধিদপ্তর, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর, কৃষি স¤প্রসারণ বিভাগ, সিটি করপোরেশন, বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন, হিসাব নিরীক্ষক কার্যালয়, জ্বালানি অধিদপ্তর, সমবায় অধিদপ্তর, খাদ্য অধিদপ্তর, সাধারণ বীমা করপোরেশনসহ অন্যান্য সংস্থার প্রশ্নফাঁস এবং উত্তরপত্র সরবরাহ করেছে। প্রশ্নফাঁস করে তারা বিপুল পরিমাণ টাকা বিভিন্ন ব্যাংক ও বিকাশের মাধ্যমে এবং নগদে হাতিয়ে নিয়েছে।
ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার একেএম হাফিজ আক্তার বলেন, রুপা ফাঁস হওয়া প্রশ্নে পরীক্ষা দেওয়ার পাশাপাশি মধ্যস্থতার কাজ করতেন। পরীক্ষার্থী সংগ্রহ ও তাদের কাছে ডিভাইস সরবরাহের কাজ করেছেন তিনি। জিজ্ঞাসাবাদের তাদের কাছ থেকে চক্রের আরও কিছু সদস্যের নাম আমরা পেয়েছি। তথ্য যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। চক্রের সঙ্গে যুক্ত অন্যদেরও গ্রেপ্তার করা হবে।
ডিবি গুলশান বিভাগের তদন্তসংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, আসামিদের দুই ভাগে ভাগ করে তদন্ত চলছে। একাংশের কাছ থেকে ২৫ চাকরিপ্রার্থীর সঙ্গে প্রশ্নের উত্তর সরবরাহের চুক্তির বিষয়ে তথ্য পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে ৯ জনের কাছ থেকে তারা অগ্রিম টাকা নিয়েছে বলে স্বীকার করেছে। এ চক্রের নেটওয়ার্ক অনেক বড়। চক্রের অন্যদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। চক্রটি ২০১৪ সাল থেকে অসংখ্য চাকরিপ্রার্থীকে অর্থের বিনিময়ে উত্তরপত্র সরবরাহ করেছে। এদের কেউ কেউ অতীতে গ্রেপ্তারও হয়েছে।
গত শুক্রবার বিকালে প্রতিরক্ষা মহাহিসাব নিরীক্ষকের কার্যালয়ের অধীন ডিফেন্স ফাইন্যান্স ডিপার্টমেন্টের ৫৫০টি অডিটর পদে নিয়োগের জন্য ৭০ নম্বরের পরীক্ষা হয়। পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁস ও কেন্দ্রে উত্তর পাঠানোর অভিযোগে রুপা, সিজিএ কার্যালয়ের বরখাস্ত কর্মকর্তা মাহমুদুল হাসান আজাদসহ নোমান সিদ্দিকী, আল আমিন রনি, নাহিদ হাসান, শহীদ উল্লাহ, তানজির আহমেদ, রাজু আহমেদ, হাসিবুল হাসান ও রাকিবুল হাসানকে গ্রেপ্তার করা হয়।