জাতীয়

অপহরণ-ধর্মান্তর-মৃত্যু: ২৬ দিন পর মরদেহ পেলেন বাবা-মা


Warning: strlen() expects parameter 1 to be string, array given in /home/khalinews/public_html/wp-includes/functions.php on line 262
(Last Updated On: )

অবশেষে চাকমা কিশোরী লাকিংমে চাকমার (১৫) মরদেহ পাচ্ছেন তার বাবা লালা অং চাকমা। বাবা ও স্বামীর পরিবারের দ্বন্দ্বের কারণে আইনি জটিলতায় কক্সবাজার সদর হাসপাতালের হিমঘরে ২৬ দিন ধরে পড়েছিল তার মরদেহ।

আদালতের নির্দেশে সোমবার (৪ জানুয়ারি) মৃতদেহ নিতে হাসপাতালে আসেন লাকিংমের বাবা লালা অং চাকমা। কিন্তু হাসপাতাল মর্গ থেকে মরদেহ নিতে বাবাকে দিতে হবে ২৪ হাজার টাকা বিল। এত টাকা দেওয়াও তার পক্ষে সম্ভব নয়। ফলে দুপুর পর্যন্ত অপেক্ষার পরও মেয়ের লাশ পাননি তিনি। দুপুরে মর্গের বিল দিতে সম্মত হয় এই ঘটনার তদন্ত সংস্থা র‌্যাব-১৫। এর ফলে মেয়ের মরদেহ নিতে আর বাধা নেই লালা অং চাকমার।

সোমবার বিকাল সোয়া ৩টায় মামলার দায়িত্বপ্রাপ্ত তদন্ত কর্মকর্তা র‍্যাপিড অ্যাকশান ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব) এর উপপরিদর্শক অর্জুন চৌধুরীর উপস্থিতিতে লাকিংমের চাচাতো ভাই ক্যচিং চাকমা সই করে কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতাল মর্গের হিমঘর থেকে লাকিংমে চাকমার মরদেহ গ্রহণ করেন।

হাসপাতালের লাশঘরের সামনে লাকিংমে চাকমার মা কেচিং চাকমা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘মেয়ের লাশটা পেয়েছি। আমরা নিতান্তই অসহায় দরিদ্র মানুষ। এখন আমাদের চাওয়া-একটাই যাতে আমার মেয়ের অপহরণকারি ও হত্যাকারীদের বিচার হয়।’

লাকিংমের বাবা লালা অং চাকমা বলেন, ‘অভাবের সংসার, এত টাকা দেওয়ার সামর্থ্য নেই আমার। তাই মেয়ের লাশ নিতে পারছিলাম না। অবশেষে র‌্যাব এই টাকা দিতে রাজি হয়েছে। এখন লাশ গ্রহণের জন্য অপেক্ষায় রয়েছি।’

লালা অং চাকমা বলেন, তাদের মেয়ে লাকিংমেকে অপহরণের পর জোর করে বিয়ে এবং পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। তারা প্রিয় সন্তানের (লাকিংমে) মরদেহ গ্রামে নিয়ে শেষকৃত্য করতে চান।

র‌্যাব-১৫ এর অধিনায়ক উইং কমান্ডার আজিম আহম্মেদ বলেন, নিহত লাকিংমের বাবা খুবই দরিদ্র। মর্গের বিল ২৫ হাজার টাকার জন্য মেয়ের লাশ নিতে পারছিলেন না লালা অং চাকমা। খবর পেয়ে আমরা মর্গের বিল পরিশোধ করেছি। লাকিংমে চাকমার লাশ নিতে আর কোনো বাধা রইলো না।

হাসপাতাল চত্বরে উপস্থিত সাংবাদিকদের মামলার তদন্ত কর্মকর্তা র‍্যাবের উপপরিদর্শক অর্জুন চৌধুরী বলেন, তদন্তে লাকিংমে চাকমার বয়স নাবালিকা অর্থাৎ প্রচলিত আইনে বিয়ের উপযুক্ত হয়নি তার সত্যতা পাওয়া গেছে। তাই তার যদি বিয়েও হয়ে থাকে তা আইনগতভাবে অবৈধ। তাই সার্বিক বিবেচনায় তার ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী তার শেষকৃত্য সম্পন্ন করার জন্য তার মরদেহ বাবা-মার কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এটি একটি অপহরণ মামলা হিসেবে আদালতে বিচার কার্য চলবে।

কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) শাহীন মো. আবদুর রহমান চৌধুরী বলেন, গত ৯ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় লাকিংমে চাকমাকে কয়েকজন যুবক হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে আসে। যুবকেরা কর্তব্যরত চিকিৎসকদের জানায় রোগী বিষপান করেছে। তখন কর্তব্যরত চিকিৎসক পরীক্ষা নিরীক্ষা করে জানায় হাসপাতালে আনার আগেই তার মৃত্যু হয়েছে। বিষয়টি হাসপাতালে কর্মরত পুলিশকে জানানো হয়। পুলিশ লাকিংমের মরদেহের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করে ময়না তদন্তের জন্য মর্গে পাঠায়। ১০ ডিসেম্বর লাকিংমের মরদেহের ময়না তদন্ত সম্পন্ন হয়।

এর মধ্যে আতাউল্লাহ নামে এক যুবক নিজের স্ত্রী দাবি করে মরদেহ তাকে হস্তান্তরের জন্য পুলিশকে আবেদন করে। মেয়ের অস্বাভাবিক মৃত্যুর খবর পেয়ে বাবা লালা অংও হাসপাতালে ছুটে এসে সন্তানের মরদেহ পাওয়ার আবেদন করেন। শুরু হয় আইনি জটিলতা। গত ১৫ ডিসেম্বর লালা অং চাকমা তার সন্তানের মরদেহ তাকে হস্তান্তরের জন্য টেকনাফ বিচারিক হাকিম আদালতে আবেদন জানান। আদালত শুনানি পূর্বক আবেদনটি গ্রহণ করে লাকিংমের ধর্ম পরিচয় নিশ্চিত হয়ে তার শেষকৃত্য সম্পন্ন করার জন্য র‍্যাবকে দায়িত্ব দেন।

কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার সমুদ্র উপকূলীয় ইউনিয়ন বাহারছড়ার দক্ষিণ শিলখালী এলাকার চাকমা পল্লিতে বসতি লালা অং চাকমার। জীবিকা নির্বাহ করেন সমুদ্রে মাছ ধরে ও পাহাড়ে জুম চাষ করে। তার পাঁচ সন্তানের মধ্যে দ্বিতীয় মেয়ে লাকিংমে চাকমা। অপহরণের প্রায় এক বছর পর গত ৯ ডিসেম্বর লাকিংমে চাকমাকে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়।

আদিবাসী ফোরাম কক্সবাজার জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক মংথেলা রাখাইন বলেন, গত ২৮ ডিসেম্বর মানবাধিকার কর্মীদের একটি দল টেকনাফে লাকিংমে চাকমার বাড়িতে যান। তারা পরিবার, গ্রামবাসী, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও আতাউল্লাহর পরিবারের সদস্যদের সাথে কথা বলেন। পরেরদিন দলটি লাকিংমের বাবার উপস্থিতিতে কক্সবাজার র‍্যাব-১৫ এর কর্মকর্তাদের সাথেও কথা বলেন।

লাকিংমের বাবা লালা অং চাকমা বলেন, গত বছরের পাঁচ জানুয়ারি তার মেয়ে লাকিংমেকে বাহারছড়া ইউনিয়নের মাথাভাঙ্গা এলাকার আতাউল্লাহসহ চার-পাঁচ যুবক অপহরণ করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায়। তিনি ঘটনার দিনই অপহরণের বিষয়টি স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য মোহাম্মদ হাফেজকে অবহিত করে তার মেয়েকে উদ্ধার করতে অনুরোধ করেন। কিন্তু ওই ইউপি সদস্য কোনরকম ব্যবস্থা নেননি। এরপর তিনি বিভিন্ন জায়গায় তার মেয়েকে খুঁজতে থাকেন। আতাউল্লাহর স্বজনদেরও অনুরোধ করেন। তবে তাতেও ফিরে পাননি মেয়েকে। তিনি টেকনাফ থানায় গিয়ে অপহরণের মামলার চেষ্টা করেন। কিন্তু ওই সময়ে টেকনাফ থানায় কর্মরত ওসি প্রদীপ কুমার দাশ মামলা না দিয়ে তাকে ফিরিয়ে দেন। ২৭ জানুয়ারি তিনি নিজে বাদি হয়ে কক্সবাজার জেলা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে মামলা করেন। ট্রাইব্যুনালের বিচারক মামলাটি তদন্তের জন্য পিবিআইকে আদেশ দেন।

লালা অং চাকমা তার মামলার উল্লেখ করেছেন, তার মেয়ে এখনও বয়সে শিশু। ইউনিয়ন পরিষদ কর্তৃক ইস্যু করা জন্ম সনদ অনুযায়ী তার মেয়ের বয়স মাত্র ১৪ বছর ১০ মাস। তিনি বয়স প্রমাণের কাগজপত্রও আদালতে জমা দেন। তার মেয়ে নাবালক এবং দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী তার মেয়ের বিয়ের বয়স হয়নি। তাকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আতাউল্লাহ ও তার সঙ্গীরা অপহরণ করে নিয়ে গেছে।

আদালতের আদেশে গত ৯ আগস্ট পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের পরিদর্শক ক্যশেনু মারমা তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে জমা দেন। প্রতিবেদনে তদন্ত কর্মকর্তা ক্যশেনু উল্লেখ করেন, আমি এই মামলাটি তদন্ত করতে গিয়ে সরেজমিনে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি এবং স্বাক্ষীদের সঙ্গে কথা বলেছি। প্রত্যক্ষদর্শীদের জবানবন্দিও নেওয়া হয়েছে। পাঁচজন স্বাক্ষীই ভিকটিম লাকিংমের আত্বীয়। ওই পাঁচ জন ছাড়া কেউ লাকিংমেকে অপহরণ করা হয়েছে এমন বলেননি। তাই লাকিংমে নিজে স্ব-ইচ্ছায় চলে গেছে মর্মে প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে।

মামলার বাদি লালা অং তদন্ত কর্মকর্তার প্রতিবেদনের উপর না-রাজি দিয়েছেন। এ বিষয়ে আদালত পরবর্তী শুনানির তারিখ ২৮ জানুয়ারি নির্ধারণ করেছেন বলে জানিয়েছেন বাদির আইনজীবী মোহাম্মদ মহি উদ্দীন খান।

লাকিংমে যেদিন মারা যান তার মাত্র ১৩ দিন আগে এক পুত্র সন্তান জন্ম দেন। নবজাতক সন্তান বর্তমানে আতাউল্লাহর মায়ের কাছে রয়েছে বলে জানা গেছে।

গত ২৮ ডিসেম্বর লাকিংমে চাকমার গ্রাম পরিদর্শনে যাওয়া মানবাধিকার কর্মী দলের অন্যতম সদস্য কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ফারাহ তানজিম টিটিল দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা ও আতাউল্লাহর পরিবারের সদস্যদের সাথে কথা বলে এবং লাকিংমের বয়স সংত্রুান্ত বিভিন্ন কাগজপত্র স্বচক্ষে যাচাই করে দুইটি বিষয় পুরোপুরি স্পষ্ট হয়েছে। তা হলো লাকিংমে স্বেচ্ছায় কারো সাথে যায়নি সে পরিকল্পিত অপহরণের শিকার। দ্বিতীয়ত দেশের প্রচলিত আইন মতে সে নাবালক এবং তার বিয়ের বয়স হয়নি।

এদিকে সোমবার সকাল ১১ টায় কক্সবাজার জেলা শহরের পৌরসভা কার্যালয়ের সামনের সড়কে লাকিংমে চাকমার অপহরণ, বাল্য বিয়ে, ধর্ষণ ও ধর্মান্তরিত করার প্রতিবাদে এবং তার হত্যাকারীদের বিচারের দাবিতে মানববন্ধন ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম, আদিবাসী নারী নেটওয়ার্ক, হিউম্যান রাইটস্ ডিফেন্ডারস ফোরাম, নারী প্রগতি সংঘ, রাখাইন ওমেন ফোরাম, আদিবাসী ছাত্র পরিষদ, তঞগ্যা স্টুডেন্ট কাউন্সিল এই কর্মসূচির আয়োজন করে।