চট্টগ্রামের একটি হত্যা মামলায় সাজাপ্রাপ্ত আসামীর পরিবর্তে অর্থের বিনিময়ে অন্য এক নারী সাজাভোগ করার ঘটনায় নিরাপরাধ নারী মিনুকে মুক্তি দিতে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। মিনু বর্তমানে চট্টগ্রাম কারাগারে আটক আছেন।
আজ সোমবার (৭ জুন) বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন ও বিচারপতি মহিউদ্দিন শামীমের সমন্বয়ে গঠিত ভার্চুয়াল হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন। আদালতে মিনুর পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মো. শিশির মনির। অপরদিকে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ড. মো. বশির উল্লাহ।
নিরাপরাধ জেল কাটা মিনুর পক্ষে আইনী লড়াই করা আইনজীবি গোলাম মাওলা মুরাদ পাঠক ডট নিউজকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন-হাইকোর্টে শুনানীকালে আজ আদালত মিনিুকে মুক্তির আদেশ দিয়েছেন। এ সংক্রান্ত কাগজপত্র চট্টগ্রামে পৌছলেই কারাগার থেকে মিনু মুক্তি পাবেন।
এর আগে অর্থের বিনিময়ে বা যেকোনও কৌশলে মূল আসামি নিজেকে বাঁচিয়ে নিরপরাধ ব্যক্তিকে জেলে রাখার ঘটনাকে দুর্ভাগ্যজনক বলে মন্তব্য করেছেন হাইকোর্ট।
মিনুর পক্ষের আইনজীবী আদালতকে বলেন, ‘বিগত দুই বছরে আমাদের দেশে এমন ২৬টি ঘটনা ঘটেছে। একজনের নামে আরেকজন জেলে থাকছে। অথচ আসল আসামি শনাক্তে অনেক পদ্ধতি আছে। আইবলিং পদ্ধতি আছে, এতে শনাক্ত করলে কোনও ভুল হবে না। এ বিষয়ে আমি লিখিতভাবে আদালতকে আরও জানাবো। তবে মিনুর ঘটনার পেছনে একটি চক্র কাজ করছে। এ ঘটনায় একটি বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশনা দাবি করছি।’
জবাবে আদালত বলেন, ‘আমরা মনে করি, এভাবে যদি রিয়েল (আসল) কালপ্রিট (দোষী) অর্থের বিনিময়ে হোক অথবা বিভিন্ন কৌশলের মাধ্যমে নিজেকে বাঁচিয়ে অন্য নিরপরাধ ব্যক্তিকে জেলের মধ্যে আটক রাখে, সেটা দুর্ভাগ্যজনক।’
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ড. বশির উল্লাহ বলেন, ‘আমরাও এটা চাই দোষীদের শাস্তি হোক, নিরপরাধ কেউ যাতে জেলে না থাকে।’
প্রসঙ্গত, চট্টগ্রাম কারাগারের একটি বালাম বই দেখতে গিয়ে মিনুর সাজা খাটার বিষয়টি উঠে আসে। সেখানে দেখা যায়, একজনের পরিবর্তে যাবজ্জীবন সাজা খাটছেন আরেক নারী। পরবর্তীতে বিষয়টি আদালতের নজরে আনা হলে এ মামলার প্রয়োজনীয় কাগজপত্র হাইকোর্টে পাঠানোর আদেশ দেন চট্টগ্রামের আদালত।
কোনও কিছুর মিল না থাকায় একজনের স্থলে আরেকজন জেল খাটার বিষয়টি আদালতের নজরে আনেন চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার মো. শফিকুল ইসলাম খান।
মহানগর দায়রা জজ আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) মো. নোমান চৌধুরী বলেন, ‘আদালতে সংরক্ষিত ছবি সংবলিত নথিপত্র দেখে কুলসুম আক্তার কুলসুমী আর মিনু এক নয় বলে নিশ্চিত হন জেল সুপার। যেহেতু ইতোমধ্যে এ মামলার রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করা হয়েছে, তাই মামলার উপ-নথি দ্রুত সময়ের হাইকোর্টে পাঠানো হয়।’
জানা যায়, মোবাইল ফোন নিয়ে বিবাদের জেরে ২০০৬ সালের ৯ জুলাই নগরীর রহমতগঞ্জ এলাকায় পোশাক কারখানার কর্মী কোহিনুর বেগম খুন হন। এ ঘটনায় করা মামলায় ২০০৭ সালের ২৬ অক্টোবর চট্টগ্রামের লোহাগাড়ার উপজেলার গৌরস্থান মাঝেরপাড়া গ্রামের আনু মিয়ার মেয়ে কুলসুমীকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁর স্বামীর নাম ছালেহ আহমদ। তিনি স্বামীর সঙ্গে কোতোয়ালী থানার রহমতগঞ্জে সাঈদ ডাক্তারের ভাড়া থাকেন। ২০০৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম আদালত থেকে জামিন পেয়ে কারাগার থেকে মুক্তি পান কুলসুমী। পরবর্তীতে এ মামলায় বিচার শেষে ২০১৭ সালের ৩০ নভেম্বর চট্টগ্রামের চতুর্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালত এক রায়ে কুলসুমীকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরো একবছরের
কারাদণ্ড দেয়। রায়ের দিন কুলসুমী আদালতে অনুপস্থিত থাকায় তাকে পলাতক দেখিয়ে রায় ঘোষনা করা হয়।
পরবর্তীতে ভাসমান বস্তিতে মিনুকে পায় কুলসুমী। মিনুর স্বামী ঠেলাগাড়ি চালক বাবুল সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাওয়ার পর তিন সন্তান নিয়ে চট্টগ্রামে ভাসমান বস্তিতে থাকতেন। মিনুর বাড়ি সীতাকুণ্ড উপজেলার জঙ্গল সলিমপুর জাফারাবাদ এলাকায়। তার পিতার নাম সোলাইমান ও মা সালেহ বেগম, স্বামী মোহাম্মদ বাবুল। গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার ময়নামতিতে। মিনুর দুই ছেলে ও একমেয়ে। বড় ছেলে ইয়াছিন(১২)। সে একটি দোকানের কর্মচারি। আরেকজন গোলাম হোসেন(৭) হেফজখানায় পড়ছে। ছোট মেয়ে জান্নাতুল ফেরদৌসকে (৫) দত্তক দেওয়া হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে মিনু ও তার সন্তানদের ভরনপোষন দেওয়ার প্রস্তাব দেয় কুলসুমী। বিনিময়ে একদিন আদালতে হাজির হতে হবে বলে জানানো হয় মিনুকে। আদালতে হাজির হলে তার জামিনও করিয়ে আনবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। মিনু কুলসুমীর কথায় রাজি হয়ে কুলসুমী সেজে ২০১৮ সালের ১২ জুন চট্টগ্রাম আদালতে আত্মসমর্পন করেন। এরপর তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। সেই থেকে মিনু কারাবন্দী। এরপর নিম্ন আদালতের সাজার বিরুদ্ধে ২০১৯ সালে হাইকোর্টে আপিল করেন কুলসুমী।
পরে গত ২৩ মার্চ মিনুর নথি হাইকোর্টে পাঠানোর আদেশ দেন আদালত। চট্টগ্রামের অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ শরীফুল আলম ভুঁঞার আদালত এ আদেশ দেন। পরে মামলার নথি হাইকোর্টে এলে এ বিষয়ে শুনানি শুরু হয়।