চট্টগ্রাম

টাকা দিলে টিকা মিলে


Warning: strlen() expects parameter 1 to be string, array given in /home/khalinews/public_html/wp-includes/functions.php on line 262
(Last Updated On: )

কাউন্সিলরের অনুসারী, হাসপাতালের কর্মীরা প্রকাশ্যে গ্রহণ করছেন অর্থ

ঘড়ির কাঁটায় তখন দুপুর ১টা। নগরীর মোহরায় চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) ছাফা মোতালেব মাতৃসদন হাসপাতাল গেটে প্রবেশ করতেই দেখা গেল চার যুবকের সঙ্গে তর্কে জড়িয়েছেন গার্মেন্টস কর্মী সাকেরা। কাছে গিয়ে জানা গেল তর্কের কারণ। চার যুবকের একজন সাকেরার কাছ থেকে একশ’ টাকা নিয়েও করোনার টিকা দেননি। টিকা শেষ হয়ে গেছে, তাই পরদিন এসে যোগাযোগ করতে বলেন চসিকের পোশাক পরিহিত চার যুবক। তারা স্থানীয় ৫ নম্বর মোহরা ওয়ার্ডের কাউন্সিলরের লোক বলে নিজেদের পরিচয় দেন।
ঠিক তার পাশের রুমে বসে থাকা হাসপাতালের জেনারেটর অপারেটর নুরুল হুদা দর কষাকষি করছেন ৬০ ঊর্ধ্ব এক বৃদ্ধের সঙ্গে। কাছে গিয়ে জানা গেল, ওই বৃদ্ধের টিকা দেয়ার এসএমএস আসেনি। এটা জানাতেই জেনারেটর অপারেটর প্রস্তাব দিলেন ৩শ টাকা খরচ করলেই ‘উপর থেকে’ এসএমএস এনে দিতে পারবেন তিনি। সঙ্গে টিকারও ব্যবস্থাও থাকবে। একই সময়ে আসা আরেক নারী এসেছেন টিকা দিতে। নুরুল হুদা এগিয়ে গিয়ে নিজেই প্রস্তাব দিলেন ওই নারীকে। জানালেন, ১০০ টাকা দিলে টিকার ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন।
শুধু আলোচ্য এই তিনজনের টিকাদানে টাকা খরচের প্রস্তাব এসেছে, এমন নয়।
অনুসন্ধানে ওঠে আসে, ছাফা মোতালেবে টিকা নিতে আসা প্রায় সকলকেই টিকা পেতে দিতে হচ্ছে ২০ টাকা থেকে শুরু করে ১শ টাকা পর্যন্ত। আর এসএমএস বা অন্য সমস্যা থাকলে টাকার অংক আরো বেড়ে যায়। এই টাকা প্রকাশ্যেই গ্রহণ করছেন স্থানীয় কাউন্সিলের কর্মী পরিচয়দানকারী ১০-১২ যুবক, টিকাদানের সঙ্গে জড়িত ৬ টিকাদানকর্মী, হাসপাতালের পিয়ন, কর্মচারী এমনকি দারোয়ান পর্যন্ত এ কাজে জড়িত। এক কথায় বলা চলে, টিকা ‘বাণিজ্যের উৎসব’ চলছে চসিকের এ টিকাদান কেন্দ্রটিতে।
গত দুই মাসের বেশি সময় ধরে এমন কর্মকা- চলে আসলেও এ নিয়ে কোন কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়নি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। যে কারণে নিরুপায় হয়েই টাকার বিনিময়ে টিকা গ্রহণ করতে বাধ্য হচ্ছেন গ্রহীতারা। অভিযোগ ওঠেছে, স্থানীয় কাউন্সিলরের লোকজন অনৈতিক এমন কাজে জড়িত থাকায় চুপ থাকছেন সংশ্লিষ্টরা। এই সুযোগে টিকা বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন নার্সরাও।
নিয়ন্ত্রণ করছেন কাউন্সিলারের কর্মীরাই !
খবর নিয়ে জানা গেছে, টাকার বিনিময়ে টিকাদানের কাজ নিয়ন্ত্রণ করছেন বখতিয়ার নামে স্থানীয় কাউন্সিলরের এক কর্মী। কাউন্সিলরও যাকে নিজের কর্মী বলে স্বীকার করেছেন। বখতিয়ারের নিয়ন্ত্রণে থেকেই ১০-১২ জন যুবক প্রকাশ্যে টিকা বাণিজ্যের সাথে জড়িয়েছেন। যারা চসিকের পোশাক পরে নিজেদের সরাসরি কাউন্সিলেরর লোক বলে পরিচয় দিয়ে কাজগুলো করে যাচ্ছেন। এরমধ্যে আটজনের নাম পাওয়া গেছে, তারা হলেন- আকাশ, সোহেল, সুমন, আরমান, রোহান, রোকন, আজম, জুমন। তাদের নিয়ন্ত্রণ করের স্থানীয় কাউন্সিলরের অনুসারী বখতিয়ার।
ঘটনাস্থলে গিয়ে আকাশকে তার পরিচয় জানতে চাইলে, তিনি নিজেই কাউন্সিলের লোক পরিচয় দিয়ে বলেন, ‘কাউন্সিলর আমাদেরকে এখানে দায়িত্ব দিয়েছেন। তিনিই বলেছেন দেখভাল করতে। চসিকের পোশাকও তিনি সরবরাহ করেছেন’।
তবে স্থানীয় কাউন্সিলর কাজী নুরুল আমিন মামুন এসব যুবকদের চেনেন না জানিয়ে বলেন, ‘তাদের সঙ্গে কোন সম্পর্ক নেই। আমি কাউকে কোন দায়িত্ব দেই নি’।
চসিকের ইউনিফর্ম কোথায় পেল তারা? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘কোথা থেকে কিভাবে তারা এসব পোশাক নিয়েছে। তা আমি জানি না। পোশাকের বিষয়ে আমাকে আরেকজনও অভিযোগ করেছেন। কিন্তু আমি গিয়ে সে রকম কিছু দেখিনি’।
মোবাইলে কাউন্সিলরের সঙ্গে কথা বলার পরপরই টিকাদান কেন্দ্রে এসে হাজির হন বখতিয়ার নিজেই। এসময় তিনি কাউন্সিলর পাঠিয়েছেন উল্লেখ করে বলেন, ‘আমি এখানের দায়িত্বে আছি, আমাদের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে যেন বিশৃঙ্খলা না হয় তা দেখার জন্য। পোশাকগুলোও কাউন্সিলর নিজেই দিয়েছেন’।
বখতিয়ারের বিষয়টি তুলে ধরে কাউন্সিলর মামুনকে পুনরায় মুঠোফোনে জানালে তিনি বলেন, ‘বখতিয়ার আমাদের মানুষ, বখতিয়ার ঠিক আছে। সে হয়তো কোন কারণে সেখানে গেছে। সে এসব উল্টাপাল্টা কাজের সঙ্গে থাকার কথা না’। তিনি বলেন, ‘আমার লোক যাক, তাতে সমস্যা নেই। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে লোকগুলো অন্যায়ভাবে কোন কিছু করছে কিনা’।
কাউন্সিলর বলেন, ‘টাকা পয়সা লেনদেন করে ক্লিনিকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যারা আছেন তারাই। অর্থাৎ যে টিকা মারে সে। টিকা যারা মারে, মহিলাগুলোকে আমি গিয়ে শাসিয়েও আসছি’।
টিকাদান কর্মীরা টাকা নেন প্রকাশ্যে :
টিকা দেয়ার আগে বা পরে প্রকাশ্যেই টাকা গ্রহণ করে থাকেন ছাফা মোতালের কেন্দ্রে টিকাদানকর্মীরা। বাদ নেই পিয়ন থেকে শুরু করে নার্সরাও। সরেজমিনে গিয়ে টাকা নেয়ার বিষয়টি দেখা গেছে। এরমধ্যে পাঁচ টিকাদানকর্মীর নাম অনুসন্ধানে উঠে এসেছে। এরা হলেন: লাবনী, জান্নাত, অসিত, মাহমুদা, মদিতা। কাছে গিয়ে টাকা নেয়ার বিষয়টি জানতে চাইলে লাবনী বলেন, ‘টিকা আনতে আমাদের গাড়িভাড়া দিতে হয়। সেই টাকা আমরা নিজেরাই দিয়ে থাকি। তাই খুশি মনে যে-যা দিচ্ছে তাই নিচ্ছি’। টাকা নেওয়ার বিষয়টি কি কর্তৃপক্ষ জানেন? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘জানেন, কর্তৃপক্ষ না জানলে কীভাবে টাকা নিব’। তার কথায় সাড়া দিলেন পাশের দুই সহকর্মী জান্নাত ও অসিতও।
জানতে চাইলে ছাফা মোতালেব মাতৃসদন হাসপাতালের ইনচার্জ ডা. মো. রিয়াজ আহমদ বলেন, ‘টাকা নিয়ে টিকা দিতে হবে এমন কথা কখনই বলা হয়নি। হয়তো কেউ টিকা মেরে খুশি মনে কিছু দিচ্ছে, সেটির বিষয়ে আমি না করিনি’। এসব কাজতো কাউন্সিলরের লোকজনই করছেন দাবি করে বলেন, একবার কাউন্সিলরকে ডেকে এনেছিলাম, উনাকে বলেও ছিলাম, আপনার এসব লোককে আপনি সরিয়ে নেন। তিনি বলে যাওয়ার পর দু’দিন কাউন্সিলরের লোক পরিচয়দানকারীরা আসেননি। কিন্তু আবারও তারা এসে এসব কাজ করছেন। প্রয়োজন হলে বিষয়টি আবার উনাকে জানাব’।