জাতীয়

দেশে প্রবীণদের মৃত্যুর প্রধান ৫ কারণ


Warning: strlen() expects parameter 1 to be string, array given in /home/khalinews/public_html/wp-includes/functions.php on line 262
(Last Updated On: )

সুস্থ বার্ধক্য প্রতিটি মানুষের অধিকার। কে না চায় সুস্থ থাকতে। তবে সুস্থ থাকা এবং কর্মক্ষম থাকা বাংলাদেশের মতো বিশ্বের অনেক দেশের প্রবীণ মানুষের জন্যই একটি বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ বার্ধক্য মানুষকে ক্রমশ দুর্বল করে ফেলে। হাড় দুর্বল, দাঁত নড়া, চামড়া কুঁচকে যাওয়া আর চোখের দৃষ্টি ক্ষীণ হওয়া থেকে শুরু করে নানা সমস্যা দেখা দেয় বার্ধক্যে। যা সৃষ্টি করে দ্বিধা আর সংকোচে। কেউ কেউ আবার জটিল ব্যাধিতে আক্রান্ত হন। অনেকেই নিজের যত্ন নেন না। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বার্ধক্যে রোগ-জরাগ্রস্ত হয়ে নাজুক অবস্থায় পড়া ঠেকাতে দরকার সচেতনতা আর সতর্কতা এবং নিজের প্রতি যত্ন।

প্রবীণ মানুষেরা বেশি আক্রান্ত হন এবং ভোগেন এমন কিছু অসুখ রয়েছে, যা আগে থেকে জীবনযাপনে কিছু পরিবর্তন আনলে এড়ানো সম্ভব। বার্ধক্য ও মৃত্যু দুটোই অবশ্যম্ভাবী, কিন্তু সচেতন হলে ভোগান্তিকে দূরে ঠেলে দেওয়া সম্ভব।

বার্ধক্যের বয়স কত?

বাংলাদেশের ৬০ বছরের বেশি বয়সী মানুষকে প্রবীণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সরকারি হিসেবে এমন মানুষের সংখ্যা দেড় কোটির মতো, যাদের বয়স ৬০ বছরের বেশি। পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ হিসেবে, দেশে বতর্মানে মানুষের গড় আয়ু ৭২ বছর আট মাস।

বার্ধক্যে যেসব রোগ বেশি হয়, যেসব রোগে মৃত্যু বেশি

বাংলাদেশে করোনাভাইরাস আক্রান্ত হয়ে গত দেড় বছরে যত মানুষ মারা গেছেন, তাদের মধ্যে সর্বোচ্চ সংখ্যক মানুষের বয়স ছিল ৬০ বছরের বেশি। তাদের বেশিরভাগের শরীরে কোনো-না-কোনো কো-মরবিডিটি বা একাধিক প্রাণঘাতী ব্যাধির উপস্থিতি ছিল। বাংলাদেশে প্রবীণদের সাধারণত একাধিক জটিলতায় ভুগতে দেখা যায়।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ ২০২০ সালের জরিপে প্রবীণ মানুষেরা যেসব রোগে বেশি মারা যান তার একটি পরিসংখ্যান দেওয়া হয়েছে, তার ভিত্তিতে হিসেব করা হয়েছে বাংলাদেশে বয়ষ্ক মানুষেরা কোন রোগগুলোতে সবচেয়ে বেশি ভোগেন। দেখা যাচ্ছে, যেসব রোগ প্রবীণ মানুষের শারীরিক ভোগান্তি যা তাদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে পারে, তার মধ্যে শীর্ষে রয়েছে হৃদরোগ এবং এ সংক্রান্ত অন্যান্য রোগ, ব্রেইন স্ট্রোক, শ্বাসতন্ত্রের অসুখ, অ্যাজমা, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, কিডনি অসুখ। এছাড়াও আছে লিভারের অসুখ এবং বাতের ব্যথা। ক্যান্সারেও বাংলাদেশে অনেক মানুষ মারা যান, এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হন লিভার ক্যান্সার, পাকস্থলীর ক্যান্সার ও ব্লাড ক্যান্সার।

বার্ধক্যে সুস্থ থাকতে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চলতে হবে। এর বাইরে বার্ধক্যে অচিহ্নিত বা অজানা রোগে মারা যান ২৩ শতাংশের বেশি মানুষ। বাংলাদেশে প্রবীণদের সেবায় প্রতিষ্ঠিত সবচেয়ে পুরনো সংগঠন, প্রবীণ হিতৈষী সংঘের একজন চিকিৎসক ডা. মাহবুবা আক্তার বলছেন, দেশে বেশির ভাগ প্রবীণের হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, কিডনি জটিলতা, পুরুষদের ক্ষেত্রে প্রোস্টেট গ্লান্ডে জটিলতা থাকে।

হৃদরোগ

পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ ২০২০ সালের জরিপ বলছে বাংলাদেশে প্রবীণ মানুষেরা যে সব রোগে ভুগে মারা যান, তার সর্বোচ্চ ২৪ শতাংশই মারা যান হৃদরোগ এবং এ সংক্রান্ত অন্যান্য রোগে। আমাদের হৃদপিণ্ডে যে রক্ত প্রবাহিত হয়, তা হৃদযন্ত্রে আসে ধমনী দিয়ে। সেটি যখন সরু হয়ে গেলে নালীর ভেতরে রক্ত জমাট বেঁধে যেতে পারে। তখন নালীর ভেতর দিয়ে রক্ত প্রবাহ বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এতে হৃদযন্ত্রের পেশীগুলো দুর্বল হয়ে যায়, তখন আর সে অক্সিজেন প্রবাহিত করতে পারে না।

হৃদপিণ্ডের ভেতর দিয়ে অক্সিজেন প্রবাহিত না হতে পারলেই হার্ট অ্যাটাক হয়। হৃদরোগের প্রাথমিক উপসর্গ খেয়াল না করলে তার ফলে কেবল মৃত্যু নয়, বেঁচে থাকলেও অনেক জটিলতা নিয়ে বাঁচতে হয়। ফলে বুকে চাপ চাপ ব্যথা, শরীরের অন্য অংশে ব্যথা, মাথা ঘোরা বা ঝিমঝিম করা, ঘাম হওয়া, নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসা, বমি ভাব হওয়া এবং বুক ধড়ফড় করা বা বিনা কারণে অস্থির লাগার মত উপসর্গ দেখলে সতর্ক হোন।

ব্রেইন স্ট্রোক

পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশে প্রবীণ মানুষের মৃত্যুর দ্বিতীয় শীর্ষ কারণ ব্রেইন স্ট্রোক, এতে মারা যান সাড়ে ১১ শতাংশ প্রবীণ মানুষ। স্ট্রোক বলতে সাধারণত মস্তিষ্কে রক্ত চলাচলে ব্যাঘাত ঘটাকে বুঝানো হয়। স্ট্রোক দুই ধরনের হয়- রক্তক্ষরণ জনিত বা হেমোরেজিক স্ট্রোক এবং স্কিমিক স্ট্রোক, এতে রক্তক্ষরণ হয় না। মস্তিষ্কে যে রক্ত যায় তা ক্যারোটিড আর্টারী অর্থাৎ গলার ভেতর দিয়ে যায় যেসব রক্তনালী, তাতে চর্বি জমে রক্তনালী সংকীর্ণ হয়ে রক্ত প্রবাহ কমে যেতে পারে। তার ফলে স্কিমিক স্ট্রোক হয়।

শ্বাসতন্ত্রের রোগ

বাংলাদেশে প্রবীণদের মৃত্যুর তৃতীয় শীর্ষ কারণ শ্বাসতন্ত্রের অসুখ, যাতে মারা যান ১১ শতাংশ বয়স্ক মানুষ। দেশের প্রবীণদের মধ্যে শ্বাসতন্ত্রের জটিলতায় যারা ভোগেন তাদের অধিকাংশ ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ বা সিওপিডিতে ভোগেন। বাংলাদেশে ৪০ বছরের বেশি বয়সী মানুষের ২১ শতাংশ সিওপিডিতে ভুগছেন। এ রোগে আক্রান্ত মানুষের শ্বাসনালী সংকুচিত হয়ে পড়ে, ফলে শ্বাসপ্রশ্বাসে সমস্যা হয়। যাদের ধূমপানের ইতিহাস আছে তারা এ রোগে বেশি আক্রান্ত হন।

ডায়াবেটিস

বাংলাদেশে বয়স্ক মানুষের মৃত্যুর আরেকটি কারণ ডায়াবেটিস। জীবনযাপন পদ্ধতিতে পরিবর্তন আসার ফলে এখন বাংলাদেশে কেবল বয়স্ক মানুষ নন, অনেক অল্প বয়সী মানুষও ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছেন। বাংলাদেশে মোট ডায়াবেটিস আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা এক কোটি ১০ লাখের বেশি। দীর্ঘদিন ডায়াবেটিস শনাক্ত থাকলে বা চিকিৎসা না হলে কিডনি, লিভার, চোখ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেই সঙ্গে শরীরের ত্বক নষ্ট হয়ে যায়, চুল পড়ে যায়। জন্য দ্রুত শনাক্ত করে চিকিৎসা নিতে হবে।

কিডনি সংক্রান্ত জটিলতা

বাংলাদেশে সরকারি তথ্য অনুযায়ী, দেশে দুই কোটির বেশি মানুষ কোনো না কোনোভাবে কিডনি রোগে ভুগছে। কিডনি রোগীর জন্য দুই ধরনের চিকিৎসা পদ্ধতি রয়েছে- হয় ডায়ালাইসিস অর্থাৎ যন্ত্রের মাধ্যমে কৃত্রিমভাবে কিডনির কাজ করানো বা কিডনি প্রতিস্থাপন। দুই ধরনের চিকিৎসা পদ্ধতিই ব্যয়বহুল, ফলে দেশের প্রায় ৮০ শতাংশের মতো কিডনি রোগী অর্থাভাবে চিকিৎসা করতে পারেন না।

প্রতিকার কী

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রবীণ বয়সে সুস্থ থাকতে চাইলে আগে থেকে পরিকল্পনা করতে হবে। এছাড়া জটিল রোগে আক্রান্ত হবার আগেই সতর্ক হওয়া দরকার। দুরারোগ্য বা জন্মগত ব্যাধি না হলে কেবলমাত্র লাইফস্টাইলে পরিবর্তন করে সুস্থ থাকা সম্ভব বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা।

প্রবীণদের রোগ আর চিকিৎসা নিয়ে বিবিসি বাংলা জাতীয় বক্ষব্যাধি হাসপাতালের চিকিৎসক কাজী সাইফুদ্দিন বেননূর, প্রবীণ হিতৈষী সংঘের একজন চিকিৎসক ডা. মাহবুবা আক্তার এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের হৃদরোগ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক হিমেল সাহার সঙ্গে কথা বলেছে।তারা প্রবীণ মানুষের সুস্থ থাকার জন্য আগাম সতর্কতা এবং প্রতিকার হিসেবে যেসব পরামর্শ দিয়েছেন তার মধ্যে রয়েছে-

• বয়স ৪৫ বছর পার হলেই নিয়মিত রুটিন চেকআপ করাতে হবে, যার মধ্যে হার্ট, কিডনি, লিভার, ফুসফুস এবং পাকস্থলীর পরিস্থিতি জেনে ব্যবস্থা নিতে হবে।
• খাদ্যতালিকা এমন তৈরি করতে হবে যেন তাতে শর্করার পরিমাণ কম থাকে, জাঙ্কফুড বা ভাজাপোড়া না থাকে, তেল ও তেলজাতীয় খাবারও কম খেতে হবে।
• নিয়মিত শরীরচর্চার অভ্যাস করতে হবে। প্রতিদিন হাটতে পারলে ভালো, না হলে ঘাম ঝরানোর একটি সাপ্তাহিক হিসাব তৈরি করে ফেলতে হবে।
• হাইপার টেনশন থাকলে সেটি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে, মানসিক প্রশান্তির জায়গা খুঁজে বের করতে হবে।
• প্রতিদিন নিয়ম করে কিছু সময় শ্বাসের ব্যায়াম করতে হবে। এজন্য নিঃশ্বাস টেনে নিয়ে ফুসফুসে ধরে রেখে ছেড়ে দেওয়া, বক্ষ প্রসারিত হয় এমন ভাবে বড় বড় নিঃশ্বাস নেওয়ার ব্যায়াম করতে হবে।
• ধূমপানের অভ্যাস থাকলে দ্রুত বাদ দিতে হবে।
• খোলামেলা জায়গায় বিশেষত দূষণ-মুক্ত কোনো জায়গায় প্রতিদিন কিছু সময় কাটাতে হবে।
• বয়স্ক মানুষের ঘরে যেন আলো-বাতাস পর্যাপ্ত থাকে তা নিশ্চিত করা জরুরী।
• উচ্চ রক্তচাপ এবং ডায়াবেটিস থাকলে তা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখার চেষ্টা করতে হবে।
• রক্তে সুগারের মাত্রা নিয়মিত মাপতে হবে এবং সে অনুযায়ী ওষুধ বা ইনসুলিন নিতে হবে।
• নিয়ম মেনে সকালে ঘুম থেকে ওঠা ও রাতে ঘুমাতে যাওয়ার অভ্যাস তৈরি করা।
• তিন ধরণের সাদা খাবার- ভাত, লবন, চিনি খাওয়া নিয়ন্ত্রিত হতে হবে।
• পানিসহ তরল জাতীয় খাবার প্রচুর পরিমাণে খাওয়া।
• শরীরের সঙ্গে সঙ্গে মনেরও যত্ন নিতে হবে। যাদের পরিবার বা স্বজন কাজের সূত্রে দূরে আছেন, তাদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করলে মনে প্রশান্তি পাবেন, অযথা উদ্বেগ ও বিষণ্ণতা কেটে যাবে।

সূত্র : বিবিসি বাংলা