জাতীয়

দেশে ২০৫০-এর মধ্যে উদ্বাস্তু হবে প্রায় ২ কোটি


Warning: strlen() expects parameter 1 to be string, array given in /home/khalinews/public_html/wp-includes/functions.php on line 262
(Last Updated On: )

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর মোংলায় দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্রবন্দর অবস্থিত। এটি একটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, যেখানে বিভিন্ন কারখানায় কাজ করেন হাজার হাজার জলবায়ু উদ্বাস্তু। দেশের বিভিন্ন জলবায়ু প্রভাবিত অঞ্চলের এই মানুষরা তাদের বাড়িঘর, জমি এবং জীবিকা হারিয়েছেন। কিন্তু বঙ্গোপসাগর থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার অভ্যন্তরে নদীতীরবর্তী উপকূলীয় শহর মোংলায় তারা একটি নতুন জীবন খুঁজে পেয়েছেন। প্রায় দেড় লাখ মানুষ এখন মোংলায় বাস করেন, যাদের মধ্যে অনেকেই সুন্দরবনের কাছের গ্রাম থেকে এসেছেন। এখানেই আছে বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন, যা বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্তে বিস্তৃত এবং বিপন্ন রয়েল বেঙ্গল টাইগারের আশ্রয়স্থল। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সামনের দশকগুলোতে ত্বরান্বিত হবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। গত মাসে প্রকাশিত জাতিসংঘের একটি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিবেদন অনুসারে, আগামী ৩০ বছরে ১৪৩ মিলিয়ন মানুষ খরা, তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং অন্যান্য জলবায়ু বিপর্যয়ের কারণে বিপদের মুখে পড়বে। এশিয়া ইতোমধ্যেই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত মহাদেশগুলোর মধ্যে একটি, এখানকার নেতারা বড় ধরনের পরিবর্তনের মোকাবিলা করতে ইতোমধ্যেই ঝাঁপিয়ে পড়েছেন।

ঢাকাভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের পরিচালক সালেমুল হকের মতো জলবায়ু বিজ্ঞানীরা মোংলাকে উদ্বাস্তুদের জন্য একটি জলবায়ু সহনশীল শহর হিসেবে চিহ্নিত করছেন। গবেষকরা বলছেন, উদ্বাস্তুরা কীভাবে নতুন সুযোগকে কাজে লাগিয়ে অভিযোজনের একটি নতুন পদ্ধতির মাধ্যমে তাদের জীবনকে পরিবর্তন করতে পেরেছে তার উদাহরণ হিসেবে উঠে এসেছে মোংলা। শহরটি উদ্বাস্তুদের নতুন সুযোগ দিয়েছে। এর সমুদ্রবন্দর, রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল এবং জলবায়ু-সহনশীল অবকাঠামোর কারণে মোংলা দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে। আমরা মোংলা মডেলটিকে বাংলাদেশের অন্তত দুই ডজন অন্যান্য উপকূলীয় শহরে জলবায়ু উদ্বাস্তুদের নিরাপদ আবাস হিসেবে প্রতিলিপি করার আশা করছি।

সালেমুল হক আরও বলেন, এক ডজনেরও বেশি স্যাটেলাইট শহর, সমুদ্র ও নদী বন্দরের মতো অর্থনৈতিক হাব সংলগ্ন অঞ্চলকে ইতোমধ্যেই সম্ভাব্য অভিবাসীবান্ধব স্থান হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব গৌণ শহরগুলো যেখানে জনসংখ্যা এখন অর্ধ মিলিয়ন এগুলো আরও অর্ধ মিলিয়ন জলবায়ু অভিবাসীকে আশ্রয় দিতে পারে। এভাবে আগামী এক দশকে কমপক্ষে ১০ মিলিয়ন জলবায়ু অভিবাসীকে বিকল্প স্থান দেওয়া সম্ভব।

জলবায়ু বিজ্ঞানীরা বলছেন, নিম্নভূমির বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের জন্য অত্যন্ত ঝুঁঁকিপূর্ণ এবং লক্ষ লক্ষ মানুষ বাস্তুচ্যুত হওয়ার ঝুঁঁকিতে রয়েছে- সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, নদীভাঙন, ঘূর্ণিঝড় এবং লবণাক্ত পানির অনুপ্রবেশের কারণে জলবায়ু উদ্বাস্তুর সংখ্যা বাড়ছে। বিশ্বব্যাংক গত বছর একটি নতুন প্রতিবেদনে বলেছে যে, ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে ১৯ মিলিয়নেরও বেশি জলবায়ু উদ্বাস্তু থাকবে, যা সমগ্র দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের প্রায় অর্ধেক। হক বলেন, ঢাকার মতো বড় শহরে জনসংখ্যা বৃদ্ধির পরিবর্তে মোংলার মতো প্রায় দুই ডজন ছোট উপকূলীয় শহরে রূপান্তরমূলক অভিযোজনের পদ্ধতির মাধ্যমে কমপক্ষে ১০ মিলিয়ন জলবায়ু উদ্বাস্তুকে পুনর্বাসন করা যেতে পারে। রূপান্তরমূলক অভিযোজনের দৃষ্টিভঙ্গি হলো জলবায়ু অভিবাসীদের জন্য এমন পরিবেশ তৈরি করে দেওয়া যেখানে তারা বসবাস এবং কাজ করার সুযোগ পাবে। যেমন লবণাক্ত জমিতে সহনশীল ধানের ফলন বাংলাদেশে বছরের পর বছর ধরে চলছে, যা উদ্বাস্তুদের জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় সহায়তা করছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, বাংলাদেশ সরকার প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে ঝুঁঁকিপূর্ণ লোকদের নিয়ে জলবায়ু সহনশীল অবকাঠামোসহ মোংলা শহরকে রক্ষা করতে লক্ষ লক্ষ বাংলাদেশি টাকা (হাজার হাজার ডলার) ব্যয় করেছে। গত চার বছরে মোংলায় রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ দ্বিগুণ হয়েছে, বেড়েছে বিদেশি বিনিয়োগ। এই অঞ্চলের জলবায়ু উদ্বাস্তুদের জন্য কারখানাগুলোতে নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া এবং চীন থেকে আসা তহবিলগুলো শরণার্থীদের বড় শহরে যেতে বাধা দিয়েছে। সরকারি নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল কর্তৃপক্ষের মুখপাত্র নাজমা বিনতে আলমগীর বলেছেন, মংলায় শিগগিরই উৎপাদন শুরু করার জন্য আরও ১০টি কারখানা পাইপলাইনে রয়েছে, যা হাজার হাজার কর্মসংস্থান তৈরি করবে। এ অঞ্চলের যেসব মানুষ দুর্ভোগে পড়েছেন তাদের জন্য এটি অবশ্যই একটি সুখবর। মোংলা মেরিন ড্রাইভ বরাবর ১১ কিলোমিটার (৭ মাইল) বাঁধ তৈরি করেছে যা বন্যা রোধ করার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে। মোংলা শহরকে ভাঙন ও জোয়ার-ভাটা থেকে রক্ষা করতে আরও বিনিয়োগ দরকার। মানুষ এখন নিরাপদ বোধ করে, কিন্তু আমাদের আরও কিছু করতে হবে , বলেন মোংলার মেয়র শেখ আবদুর রহমান। রহমান বলেন, সরকার সমুদ্রবন্দরে নতুন অবকাঠামো নির্মাণ করছে এবং মোংলা নদীর চ্যানেল প্রশস্ত করতে ড্রেজিং করছে, বড় জাহাজ চলাচলের অনুমতি দিচ্ছে, অন্যদিকে রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল বা ইপিজেডে আরও বিনিয়োগ আসছে। তিনি বলেন, প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে সীমান্তের ওপারে একটি বড় স্থলবন্দরের সঙ্গে শহরটিকে যুক্ত করতে একটি নতুন রেললাইন নির্মাণ করা হচ্ছে।

২০১৮ সালে মোংলা ইপিজেডে মাত্র ২,৬০০ জন শ্রমিক ছিল, কিন্তু এখন বিভিন্ন কারখানায় প্রায় ৯,০০০ শ্রমিক নিযুক্ত রয়েছে। বছর আটাশের রেশমা বেগম তাদের মধ্যে একজন। বেগম নদীতে মাছ ধরতেন, কিন্তু নদী ভাঙন তার বাড়ি গ্রাস করে ফেলে, ফলে তার তিন সদস্যের পরিবার গৃহহীন হয়ে পড়ে। এখন তিনি অন্য একজনের জমিতে অস্থায়ীভাবে বসবাস করছেন এবং ইপিজেডের একটি কারখানায় কাজ করেন। বেগম জানান, এখন আমি আমার পরিবারকে সাহায্য করার জন্য প্রতি মাসে ভালো পরিমাণ অর্থ উপার্জন করি। তার স্বামী পেশায় একজন দিনমজুর। স্বামী-স্ত্রী দুজনে মিলে এখন নিজেদের বাড়ি গড়ার স্বপ্ন দেখছেন।