জাতীয়

প্রেমের টানে বাঙালি তরুণীর ‘অভিশপ্ত’ রোহিঙ্গা জীবন


Warning: strlen() expects parameter 1 to be string, array given in /home/khalinews/public_html/wp-includes/functions.php on line 262
(Last Updated On: )

রোহিঙ্গা যুবককে ভালোবেসে ছেড়েছিলেন স্বজন, পরিবার। বিয়ের পর রোহিঙ্গা তালিকায় নিবন্ধিত হয়েছিলেন চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ার এক নারী। তবে যার জন্য ঘর ছাড়া সেই যুবকই এক সময় ছেড়ে যায় তরুণীকে। তত দিনে জন্ম নিয়েছে দুই সন্তান। দুই চোখে অন্ধকার দেখা তরুণী টিকে থাকার জন্য পাড়ি জমানোর চেষ্টা করেন মধ্যপ্রাচ্যে। তবে পাসপোর্ট করতে গেলে কারাগারে যেতে হয় তাকে; তবে শেষ পর্যন্ত আইনি লড়াইয়ে বাঙালি প্রমাণিত হওয়ায় মুক্তি পেয়েছেন তিনি।

সিনেমার কাহিনিকে হার মানানো এই তরুণীর নাম সিরাজ খাতুন (৩৩)। ২৫ দিন জেল খাটার পর মঙ্গলবার তিনি মুক্তি পেয়েছেন চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে।

মানবাধিকার সংস্থার হস্তক্ষেপে জামিনে মুক্ত হয়ে মঙ্গলবার সাংবাদিকদের তিনি শোনান বিভীষিকাময় জীবনের গল্প।

স্থানীয় সংসদ সদস্যের জিম্মায় গত ১৬ জুন সিরাজ খাতুনকে জামিন দেন চট্টগ্রাম মহানগর হাকিম শফি উদ্দিন। এর পর মঙ্গলবার বেলা ১১টার দিকে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে তিনি মুক্তি পান।

আদালত ও মামলার এজাহার সূত্রে জানা গেছে, সিরাজ খাতুন রাঙ্গুনিয়া উপজেলার পূর্ব খুরুশিয়া গ্রামের মৃত নুর ইসলামের মেয়ে। জাতীয় পরিচয়পত্রসহ বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে তার যাবতীয় কাগজপত্র রয়েছে।

রাঙ্গুনিয়ার উত্তর পদুয়া এলাকায় প্রায় এক যুগ আগে পরিচয় গোপন করে মসজিদে মুয়াজ্জিনের কাজ করতেন রোহিঙ্গা যুবক মো. সিদ্দিক। পাশাপাশি অন্যের ফসলি জমিতে চাষাবাদও করতেন। সিদ্দিকের সঙ্গে ওই এলাকার সিরাজ খাতুনের প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ২০১০ সালে তারা পালিয়ে বিয়ে করেন। এরপর সিরাজ জানতে পারেন, তার স্বামী রোহিঙ্গা। শুরু হয় পুলিশের হাত থেকে পালিয়ে বেড়ানোর জীবন।

সিরাজ জানান, চট্টগ্রামের নানা জায়গায় ঘুরেও কোথাও থিতু হতে পারছিলেন না তারা। ২০১৭ সালে পটিয়ায় থাকার সময় ধরা পড়েন পুলিশের কাছে। পুলিশ তাদের পাঠিয়ে দেয় উখিয়ার পালংখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। সেখানে বিভিন্ন দাতা সংস্থার ত্রাণের আশায় সিরাজকে রোহিঙ্গা হিসেবে তালিকাভুক্ত করেন সিদ্দিক। সিরাজের নতুন নাম তখন সালমা খাতুন।

ক্যাম্পে নতুন চেহারা পায় সিদ্দিকের, নিয়মিত সিরাজকে নির্যাতন করতেন তিনি। এরই মধ্যে জন্ম নেয় দুই সন্তান। ২০১৯ সালে সিদ্দীক স্ত্রী-সন্তানদের রেখে হঠাৎ উধাও হয়ে যান। অসহায় সিরাজ দুই সন্তানকে নিয়ে ফিরে যান রাঙ্গুনিয়ায় বাবার বাড়িতে।

সিরাজ বলেন, ‘পরিবার জানত না আমি রোহিঙ্গাকে বিয়ে করেছি। সব শুনে তারা হতভম্ব হয়ে পড়ে। মানসম্মান রক্ষায় আমাকে ওমান পাঠিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা করা হয়।’

ওমান যাওয়ার জন্য ৩ জুন পাসপোর্ট বানাতে ডবলমুরিংয়ের মনসুরাবাদ কার্যালয়ে যান সিরাজ। তবে পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তারা তাকে আটক করেন। সিরাজের ফিঙ্গার প্রিন্টে দেখা যায়, তিনি একজন রোহিঙ্গা, নাম সালমা খাতুন। এরপর এক বছর বয়সী সন্তানসহ তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। আদালতের মাধ্যমে পাঠানো হয় কারাগারে।

ঘটনাটি জানাজানি হওয়ার পর সিরাজকে সহায়তায় এগিয়ে আসে চট্টগ্রামভিত্তিক বেসরকারি মানবাধিকার সংগঠন বিএইচআরএফ। আইনি সহায়তা দিয়ে আদালতে বিষয়টি তুলে ধরে জামিন আবেদন করা হয়। বিচারক বিষয়টি আমলে নিয়ে সিরাজকে জামিন দেন।

বিএইচআরএফ চট্টগ্রামের সভাপতি অ্যাডভোকেট এ এম জিয়া হাবীব আহসান বলেন, ‘দুই দফা আবেদন করেও সিরাজ খাতুনের জামিন হয়নি। তবে তৃতীয়বার আদালতের কাছে সিরাজ খাতুনের অসহায়ত্ব সম্পূর্ণ তুলে ধরলে বিচারক তা বুঝতে পারেন। অবশেষে তিনি কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি পেলেন।’

মুক্তির পর সিরাজ বলেন, ‘পাসপোর্ট অফিস থেকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়ার সময় বার বার বলছিলাম, আমি রোহিঙ্গা না, প্রতারণার শিকার হয়েছি। কিন্তু তারা বিশ্বাস করেনি। পরে আমার পরিবার আইনজীবীর মাধ্যমে আদালতে বিষয়টি তুলে ধরে। আমি ২০০৮ সালে বাংলাদেশে ভোটার হয়েছি। আমি বাংলাদেশি। আমি তার (স্বামী) বিচার চাই। রোহিঙ্গা তালিকা থেকে মুক্তি চাই।’

২০১৮ সালে পুলিশের হাতে আটক হন সিদ্দিক ও সিরাজ খাতুন। এ সময় এই দম্পতিকে টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পাঠায় পুলিশ। এরপর ভাতা পাওয়ার লোভে সিরাজ খাতুনকে ‘রোহিঙ্গা’ হিসেবে ক্যাম্পে নিবন্ধন করেন তার স্বামী। সিরাজ খাতুনের নাম সালমা খাতুন দিয়ে বাবার নাম উল্লেখ করা হয় মো. ইসহাক।

কিছুদিন ক্যাম্পে থাকার পর স্বামী ক্যাম্প ছেড়ে পালিয়ে গেলে রাগুনিয়া ফিরে আসেন সিরাজ খাতুন। এরপর আত্মীয়-স্বজনের পরামর্শে ওমানে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন তিনি। এজন্য গত ৩ জুন চট্টগ্রাম বিভাগীয় অফিসে পাসপোর্ট করাতে যান।

পাসপোর্ট অফিসে সিরাজ খাতুনের আঙুলের ছাপ যাচাই করে তাকে রোহিঙ্গা নারী ‘সালমা খাতুন’ হিসেবে শনাক্ত করে কর্তৃপক্ষ। এরপর তাকে ৯ মাসের শিশু সন্তানসহ নগরের ডবলমুরিং থানায় মামলা করে পুলিশের হাতে তুলে দেয় পাসপোর্ট অফিস। সেখান থেকে পুলিশ ৪ জুন তাকে সংশ্লিষ্ট মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে পাঠায়। ওইদিন আদালত সিরাজ খাতুনকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।

সবকিছু জেনে সিরাজ খাতুনের পক্ষে আইনি লড়াইয়ে নামেন বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন চট্টগ্রাম চ্যাপ্টারের প্রেসিডেন্ট অ্যাডভোকেট জিয়া হাবীব আহসান। তিনি গত ১৬ জুন আদালতে সিরাজ খাতুনের পক্ষে জামিন আবেদন শুনানি করেন। শুনানিতে সিরাজ খাতুনের বাংলাদেশি নাগরিকত্বের যাবতীয় প্রমাণপত্র উপস্থাপন করা হয়। এরপর নানা প্রক্রিয়া শেষে জামিন পান সিরাজ খাতুন।