প্রধান পাতা

আজ বিশ্ব ঘুম দিবস


Warning: strlen() expects parameter 1 to be string, array given in /home/khalinews/public_html/wp-includes/functions.php on line 262
(Last Updated On: )

আজ ১৮ মার্চ বিশ্ব ঘুম দিবস। তবে সকল ১৮ মার্চ বিশ্ব ঘুম দিবস নয়। এই বিষয়ে পরে আসছি। তার আগে বলে রাখি, শিরোনামে ঘুম দিবসের কথা শুনে, মনে মনে কিছুটা হলেও ভাবতে গিয়ে অনেক পাঠকের ঈষৎ হাসির খোরাক সৃষ্টি হয়েছে। হাসির উদ্রেক বা খোরাক সৃষ্টি হলেও আপনার মত আমি, কিংবা আমার মত আপনি স্বাভাবিক ঘুমের অধিকারি হলে, বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবনে আমরা সক্ষম নাও হতে পারি। কারণ যেখানে বলিউড তারকা অমিতাভ বচ্চন টুইট করে বলেন ‘ঘুম দিবস, এটা আবার কি!’ তখন ঘুমদিবস নিয়ে নিশ্চয় ঋণাত্বক মনোভাব সৃষ্টি হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। আবার ঘুম নিয়ে আন্তর্জাতিক দিবস ঘোষণা হওয়ায়, এই নিয়ে সর্বসাধারণের আরো কৌতুহল জাগা স্বাভাবিক বিষয়। তবে জাতিসংঘ বা অন্যকোন সংস্থা কর্তৃক ঘুমকে আন্তর্জাতিক দিবস পালনের জন্যে ঘোষণা করাটায় বুঝে নিতে হবে নিশ্চয় এর মর্ম বা গুরুত্ব রয়েছে। যাইহোক, এবার একটি অভিনব ঘুমের কথায় আসি, যা জেনে আন্তর্জাতিক ঘুমদিবস ঘোষণার তাৎপর্য অনুধাবনে সক্ষম হব। আমরা নিশ্চয় অনেকেই মানিকগঞ্জের সদর উপজেলার কৃষ্ণপুর গ্রামের ৩৮ বছর বয়সী ভোম্বল শীলের কথা পত্রপত্রিকায় পড়েছি বা কারো থেকে শুনেছি! সে গত ২০-২২ বছর যাবৎ টানা ৭-৮ দিন পর্যন্ত ঘুমিয়ে থাকে এবং ঘুম থেকে জেগে উঠে ১০-১২ জনের খাবার একসাথে খেয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়ে। নরসুন্দর দারিদ্র্য পরিবারের অভাবগ্রস্ত সংসারে, এই ভোম্বল শীলকে নিয়ে কত কষ্টে আছে মাতাপিতা, তাদের পরিবারের সদস্যের ভাষ্য থেকে বুঝা যায়। ঘুমের জন্যে সে চলতে পারে না, হাঁটতে পারেনা, বসতে পারেনা। টয়লেটে গেলে সেখানে টানা তিন দিন ঘুমিয়ে থাকে। টেনে হিঁচড়ে উঠাতে চাইলে, ঘুমের আরাম আরো বেড়ে যায়। ভোম্বল শীলের শৈশব কৈশোর বয়সে যদিও এমন অবস্থা ছিলনা। তার স্বাভাবিক ঘুম হত এবং অন্য দশ জনের মত স্বাভাবিক দিন অতিবাহিত করত। ১৬/১৭ বছর বয়স থেকে তার হঠাৎ এমন পরিবর্তন আর অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন শুরু হয়। যদিও পরিবার থেকে বলা হচ্ছে, এক রাতে মেলা থেকে আসার সময় ভয় পাবার কারণে হয়েছে; তবে চিকিৎসকের কথায় এটা হরমোনজনিত সমস্যার কারণে হচ্ছে। বহু চিকিৎসা করেও কোন প্রকার ফল পাওয়া যায়নি। আবার টাকার অভাবে বিদেশে নিয়ে উন্নত চিকিৎসা করাও সম্ভব হয়নি।এইতো গেল মাত্রাতিরিক্ত ঘুমের কথা। এবার নিদ্রাহীনতার কথায় আসি। আমাদের দেশে বহু সংখ্যক মানুষ আছে, যাদের ঘুম খুবই কম। দেখা যায়, মধ্যরাতে ঘুম ভেঙ্গে যায় অথবা গভীর রাত পর্যন্ত ঘুম আসেনা। শেষরাতে বা রাত চারটার পর হাল্কা ঘুম আসে। অথবা গভীররাতে, দুইটা বা তিনটার দিকে ঘুম ভেঙ্গে যায়। সবাই যখন ঘুমিয়ে থাকে তখন সাড়ারাত একা একা জেগে জেগে দুঃশ্চিন্তায় ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ে। এইগুলো কাল্পনিক কথা নয়, বিপুল সংখ্যক বন্ধুবান্ধব থেকে প্রাপ্ত তাদের বাস্তব কথায় বলছি।ঘুম বেশী হওয়া কিংবা কম হওয়া কত না যন্ত্রণাদায়ক সেই বুঝে, যার এই দুই সমস্যার যে কোন একটি রয়েছে। মহিলা পুরুষ নির্বিশেষে আমি দেখেছি, কেউ কেউ দিনে রাতে দীর্ঘ সময় ঘুমায় বা ঘুমাতে চাই। ঘুমের জন্যে দিনের স্বাভাবিক কাজ ব্যাহত হয়। তাছাড়া ঘুমের আধিক্যেতা দেহে ও মনে মারাত্বক প্রভাব পড়ে। আবার কারো ঘুম হচ্ছেনা বলে নিয়মিত ঘুমের ঔষধ সেবন করতে গিয়ে ঔষধে আসক্ত হয়ে পড়েছে। একদিকে এদের ক্রমাগত কম ঘুম হবার ফলে দারুন স্বাস্থ্য হানি ঘটছে, আবার অন্যদিকে অনেকের ঘুমের আধিক্যেতার কারণে দেহে মারাত্বক প্রভাব পড়ছে। প্রত্যেক মানুষের সুনির্দ্দিষ্ট সময় ঘুমের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। তবে সবার ঘুম একই নয়। শিশু ও বৃদ্ধ বয়সের ঘুমের যেমন পার্থক্য রয়েছে, তেমনি বয়স ভেদে শারীরিক মানসিক অবস্থা অনুয়ায়ী ঘুমের তারতম্য রয়েছে। স্বাভাবিকভাবে একজন মানুষের দৈনিক গড়ে সাত ঘন্টা ঘুমের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কিন্তু ভোম্বল শীলের মত টানা সাত দিন ধরে ঘুম যাওয়া যেমন ্অস্বাভাবিক আবার তেমনি টানা মাস খানেক ঘুম না হওয়া আরো অস্বাভাবিক।নিশ্চয় মাস খানেক ঘুম না হওয়া বলাতে, এমন দৃষ্টান্ত আছে কিনা এই নিয়ে আবারও সন্দেহ বা কৌতুহল সৃষ্টি হয়েছে। হ্যাঁ এমনও রেকর্ড রয়েছে! হয়ত এইটিও অনেকের অসম্ভব ব্যাপার মনে পারে! তাহলে এই বিষয়টি নিয়ে না বললে নয়। আমরা বৃটিশ পপ শিল্পী মাইকেল জ্যাকশনের নাম শুনেছি। এর নাকি টানা ৬০ দিন ঘুম না হওয়ায় মৃত্যু হয়েছে। আবার ৬০ দিন ঘুম না হওয়া মানে পুরো দুই মাস জেগেছিল তা নয়। তাঁর মৃত্যু বিষয়ক মামলার মেডিক্যাল রিপোর্টে দেখা গেছে ঔষধের প্রভাবে জ্যাকসনের স্বাভাবিক ঘুম হয়নি, তিনি অবচেতনে ছিলেন যা ছিল সাধারণ বিশ্রামের মত। তাই প্রকৃত ঘুমের অভাবে মাইকেল জ্যাকশনের ধীরে ধীরে মৃত্যু হয়েছিল বলে চিকিৎসক আদালতকে অবহিত করে। তবে কোন প্রকার অবচেতন নয়, একেবারে না ঘুমিয়ে ১৯৬৪ সালে র‌্যান্ডি গার্ডনার নামে এক আমেরিকান যুবক একটানা ১১ দিন ছিলেন। ক্যালিফোর্নিয়ার স্যান ডিয়েগো স্কুলের এই তরুণ ছাত্রের এটি ছিল বিশ্ব রেকর্ড। স্কুলের বিজ্ঞান মেলায় নতুন কি করা যায়, সেই ভাবনা থেকে ঘুম বিষয়ে সচেতনতা এবং অনিদ্রা আর অতিনিদ্রার প্রভাব সম্পর্কে সকলকে অবহিত করার উদ্দেশ্যে তার এই পদক্ষেপ। পৃথিবীর সব প্রাণীকে ঘুমোতে হয়। একেবারে মস্ত বড় হাতি থেকে শুরু করে এককোষী অ্যামিবা পর্যন্ত না ঘুমিয়ে থাকতে পারেনা। কিছু প্রাণী একটানা দীর্ঘ সময় ঘুমোয়, আবার কিছু কিছু প্রাণি বিরতি দিয়ে থেমে থেমে ঘুমোয়। তবে বিচিত্র রকমের প্রাণীর ঘুমের বৈচিত্রতা রয়েছে। আবার সব মানুষের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ একই রকম হবার সত্ত্বেও ঘুমের অভ্যাস বিভিন্ন রকম। এই যেমন- কেউ ঘুমায় কুন্ডলী পাকিয়ে বা অর্ধবৃত্তাকার হয়ে, কেউ কাৎ-চিৎ হয়ে; আবার কেউবা কোন প্রকার নড়া চড়া ছাড়া এক ঘুমেই সকাল, কেউ আবার সাড়া বিছানা চক্কর মারতে গিয়ে হাত পা ভাঙ্গার ভয়ে, চারদিকে বালিশের ব্যবহার! আবার এমনও মানুষ আছে যারা ঘুমের মধ্যে আবোল তাবোল বকে কিংবা জোড়ে জোড়ে নাক ডাকে। আর এই জন্যে সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী ভয়ে ডিভোর্স দিয়েছে এমনও বিচিত্রখবর পত্রপত্রিকায় দেখেছি। শুধু তা নয়, কেউ ভাত খাবার পর চায়ের চুমুক না হলে ঘুম হয়না, আবার কারো ভাত খাওয়ার পর চায়ের চুমুক হলে ঘুম হয়না। এই রকম আরো কত জনের কত ধরণের ঘুমের বৈচিত্রতা রয়েছে তা লিখে শেষ হবেনা। যেমন- আমারও একটা অভ্যাস আছে, নিজের ঘর ছাড়া অন্য কোথাও ঘুম হয়না। আর এই জন্যে নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সহকর্মীদের আমার মত না ঘুমানোর দলে রাখতে, বিভিন্ন সময় ভিন্ন ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করতে হয়েছে!আসলে ঘুম একটি সহজ বিষয় মনে হলেও, প্রকৃত অর্থে তা কিন্তু নয়। সেই আদিকাল হতে মানুষ ঘুম নিয়ে নানা রকম গবেষণা করে আসছে। প্রাচীন গবেষক হিপোক্রিটাস তার গবেষণায় বলেছেন, ঘুমের সাথে সৌরজগতের গ্রহচক্র ও পৃথিবীর আহ্নিক গতির প্রভাব রয়েছে। যদিও ঘুম নিয়ে এখনো অনেক গবেষণা হচ্ছে। কিন্তু ঘুম কেন হয়, কিভাবে হয় ইত্যাদি নিয়ে যেমন এখনো বির্তক রয়েছে আবার ঘুমের মধ্যে আত্মা দেহ ছেড়ে ভ্রমণে বের হওয়া ইত্যাদি নিয়ে অনেক ধরণের কল্পকাহিনীও প্রচলিত রয়েছে। তবে ঘুম বিষয়ে এখনো পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা সার্বজনীন কোন একক সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি। সিদ্ধান্তে আসুক আর নাই আসুক, প্রাণীর পর্যাপ্ত ঘুমের যে প্রয়োজনীয়তা রয়েছে, তা অনস্বীকার্য। আর এই জন্যেই ঘুম দিবসের সূচনা। শুরুতেই লিখেছিলাম, সকল ১৮ মার্চ ঘুম দিবস নয়। তাহলে ঘুম দিবস কখন, এর উত্তর খুঁজতে হয়। প্রতি বছর কেবল মার্চ মাসের মহাবিষুবের আগের শুক্রবার ঘুম দিবস পালিত হয়। অর্থাৎ মার্চ মাসের পূর্ণ দুই সপ্তাহের পরের প্রথম শুক্রবার বিশ্ব নিদ্রা দিবস হিসাবে পালিত হয়ে আসছে। সেই হিসাবে চলতি বছর এই ’২২ সালের ১৮ মার্চ বিশ্ব ঘুম দিবস। এখন কথা হচ্ছে কেন এই ঘুম দিবস! প্রকৃতপক্ষে সুনিদ্রার প্রয়োজনীয়তা সর্বসাধারণকে অবহিত করতে ২০০৮ সাল থেকে ‘ওয়ার্ল্ড অ্যাসোসিয়েশন অব স্লিপ মেডিসিন’ ঘুম দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কারণ ঘুম প্রাণিদেহে একটি অত্যাবশ্যকীয় শরীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া। নিয়মিত ও পরিমিত ঘুম সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করে। বিশ্বে প্রতিবছর ঘুমজনিত কারণে ৪৫% মানুষ স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে। কেবল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিদ্রাহীনতার কারণে প্রতিবছর ৪০০ বিলিয়ন ডলার ক্ষতি হয়ে থাকে। এই অবস্থায় বুঝা যায়, প্রাথমিকভাবে ঘুমদিবস হাস্যকর মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে তা কিন্তু নয়। আর তাই ঘুম সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করতে ‘ওয়ার্ল্ড স্লিপ সোসাইটি’ সক্রিয় রয়েছে। অতএব, আজকের ঘুম দিবস থেকে সকলে আসুন, নিয়মিত পরিমিত স্বাভাবিক ঘুম যাবার অভ্যাস গড়ে তুলি।

লিটন দাশ গুপ্ত

প্রদান শিক্ষক