লাইফ স্টাইল

ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তা ক্রমশ ডুবে যাচ্ছে সমুদ্রের বুকে, কিন্তু কেন?


Warning: strlen() expects parameter 1 to be string, array given in /home/khalinews/public_html/wp-includes/functions.php on line 262
(Last Updated On: )

২০০১-এর পর জাকার্তার ওয়ালাদুনা মসজিদে আর কোনও নমাজ পড়া হয়নি। মসজিদের বাইরে কেউ অজু করেনি নিয়ম মেনে। শুধু ধীরস্রোতে সমুদ্রের জল জায়গাটা দখল করে নিয়েছে। এই ২০২১ সালে, ওয়ালাদুনা মসজিদের ছাদ ভগ্নপ্রায়। দেওয়ালে সামুদ্রিক জলজ শ্যাওলা। পুরো মসজিদ ও তার সংলগ্ন অঞ্চল ধীরে ধীরে গ্রাস করে নিচ্ছে ভারত মহাসাগর ও জাভা সমুদ্র। প্রাচীনকালে ভারত মহাসাগরকে ইন্দোনেশিয়ার প্রহরী বলা হত। আর আজ, সেই রক্ষকই ভক্ষকের বেশে এসে দাঁড়িয়েছে ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তা-য়।

ঠিক কী হচ্ছে ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তা-তে ?

খুব স্বল্প ভাষায় বলতে গেলে, ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তা শহরটি আস্তে আস্তে ডুবে যাচ্ছে। জনবসতি থেকে প্রশাসনিক ভবন ক্রমশ চলে যাচ্ছে জলের তলার। আর এই নিমজ্জন শুরু হয়েছে প্রায় বছর দশেক আগে থেকেই। মূলত উত্তর উপকূলীয় অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি প্রকোপ দেখা যায় সমুদ্রের আগ্রাসনের। জাভা সমুদ্র চোরাস্রোতের মত ঢুকে ভিত ক্ষইয়ে দিচ্ছে এই শহরের। প্রতি বছর, গড়ে প্রায় ২৫ সেন্টিমিটার করে স্থলভাগ সমুদ্রের তলায় চলে যাচ্ছে। ফলে, ক্রমশ ধ্বসে পড়ছে শহরের এই অঞ্চল।

এই অঞ্চলে জাকার্তার সমস্ত জেলেদের বাস। জীবিকার কারণে তাঁদের উপকূলেই বাসস্থান বানাতে হয়েছে। আর তাঁরাই বিপদের মুখে পড়ছে সকলের আগে। তবে, শহরের ভিতরের মানুষদের বিপদও কিন্তু কম নয়। বিজ্ঞানীদের মতে, ২০৫০ সালের মধ্যে শহরের বেশিরভাগ অঞ্চলই গ্রাস করে নেবে সমুদ্র।

কেন এই সামুদ্রিক আগ্রাসন?

এমনিতে জাকার্তা শহরটি নিম্ন উপকূলীয় অঞ্চলে অবস্থিত। শুধু তাই নয়, ১৩ খানা নদী অববাহিকা রয়েছে এই অঞ্চলে। কিন্তু, জাকার্তার নিমজ্জনের কারণ ঠিক তা নয়। সেই যে প্রবাদ আছে না, ‘ওয়াটার ওয়াটার এভ্রিহোয়্যার, নট আ ড্রপ টু ডিংক’? জাকার্তার অবস্থাও তাই। সমুদ্র দিয়ে ঘেরা এই শহরের এক কোটিরও বেশি অধিবাসীর ঘরে পানীয় জল পৌঁছনোর কোনও ব্যবস্থা নেই। ৪০ শতাংশের বেশি জনসংখ্যা ভূগর্ভস্থ জলের উপর নির্ভরশীল। পানীয় জলের জন্য ক্রমাগত নলকূপ বসানোর ফলে মাটির নীচের জলের ভাণ্ডার শূন্য হয়ে যাচ্ছে।

এদিকে, ক্রমাগত শহরায়ণের ফলে মাটির উপর কংক্রিটের আস্তরণ তৈরি হচ্ছে। যার ফলে, বৃষ্টির জল ধুয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে সমুদ্রে। এদিকে, বনাঞ্চল হ্রাসের কারণে ভূমিক্ষয়ও ক্রমশ বাড়ছে। মাটির জলস্তর আর পূর্ণ হচ্ছে না। ফাঁপা মাটি আবহবিকারের সংস্পর্শে ধ্বসে পড়ছে, ঠিক সেই খানেই প্রবেশ করছে সমুদ্রের জল। এছাড়া, এ শহরের নিকাশি ব্যবস্থা অত্যন্ত খারাপ। নোংরা আবর্জনা মাটিতে মেশার ফলেও ভূমিক্ষয় বাড়ছে।

বিশেষজ্ঞদের দাবী, পৃথিবীর সবচেয়ে দ্রুততম নিমজ্জিত হচ্ছে এই শহর। একসময়, মানচিত্র থেকে হয়তো মুছেই যাবে।

ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তার এই দুর্ভোগের ঐতিহাসিক কারণ

জাকার্তার এই দুর্ভাগ্যের পিছনে কারণ হিসাবে দায়ী করা যায় ৪০০ বছরের শোষণের অভিশাপকে। আর তার পিছনে কিন্তু দায়ী ডাচ বা ওলন্দাজরা। যার একসময় নিজেদের কলোনি বানিয়েছিল শতাব্দী প্রাচীন এই শহরে। ষোড়শ শতকে ওলন্দাজরা প্রাচীন ‘জয়াকর্তা’ শহর দখল করে। তারপর, জয়াকর্তাকে ধুলোয় মিশিয়ে তারা তৈরি করে রাজনৈতিক কেন্দ্র বাতাভিয়া। এই শহরটি একেবারে ওলন্দাজ শহরের আকারে তৈরি। ওলন্দাজ শহরের মূল আকর্ষণ ক্যানাল বা খাল। বাতাভিয়ার মধ্যে দিয়েও অজস্র খাল কাটা হয়েছিল। এই খালগুলি মূলত যাতায়াত, ব্যবসা, প্রতিরক্ষার কাজে ব্যবহৃত হত।

সঙ্গে সঙ্গে খালের মাধ্যমে বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন অধিবাসীদের এলাকাও চিহ্নিত করা ছিল সহজ। আরব, চীনা, মুর ও স্থানীয় মানুষদের বাসস্থান ছিল আলাদা আলাদা খালের ধারে। খাল পার হয়ে এক অঞ্চল থেকে আরেক অঞ্চলে যেতে হত। আর শহরের শাসক ইচ্ছে করলেই খালের যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়ে এক একটি অঞ্চলের মানুষদের বন্দি করে রাখতে পারতেন। শহরে যেন কোণওভাবে বিপ্লব না মাথা চাড়া দেয়, এটাই ছিল ওলন্দাজদের উদ্দেশ্য।

কিন্তু খালগুলি সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ না করার কারণে ১৭০০ শতকের মাঝামাঝি সেগুলি নষ্ট হতে শুরু করে। একসময়কার প্রবহমান জল স্থির হয়ে যায়। জঞ্জাল ও প্রাকৃতিক পলি পড়ে খালগুলি হয়ে ওঠে জীবাণু ও অন্যান্য অসুখের ডিপো। বাতাভিয়ায় শুরু হয় টাইফাস ও ম্যালেরিয়ার প্রকোপ। ইউরোপীয় ও ওলন্দাজরা তখন শহরের দক্ষিণাংশে নিজেদের নতুন অঞ্চল বেছে নিয়ে বসবাস শুরু করে। শুধু তাই নয়, এই নতুন অঞ্চলে পানীয় জলের জন্য পাইপ বসানো হয়। অন্যদিকে, পুরনো অঞ্চলে খালগুলি ক্রমশ মজে যেতে থাকে। আর সেখানে পাইপ বসানোর কোণও চেষ্টাই করে না সাম্রাজ্যবাদী শক্তি।

১৮৭০ সালে জাকার্তার ধনী অঞ্চলে পাইপে করে পানীয় জল সরবরাহ শুরু হয়। কিন্তু বাকি শহরে, বিশেষ করে কামপং অঞ্চলে তার কোনও ব্যবস্থাই করা হয় না। নিরুপায় স্থানীয় মানুষরা খালের জল ব্যবহার করতে শুরু করেন। এক সময় তা আর সম্ভব না হলে নলকূপ বসানো শুরু হয়।

সমস্যার প্রাবল্য বৃদ্ধি

১৯৪৯ সালে ওলন্দাজরা জাকার্তার অধিকার ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। কিন্তু তারা রেখে যায় এমন শহর যেখানে ভয়ানক জলের কষ্ট। এরপর শুরু হয় শহরে জনবিস্ফোরণ। ২০১৫ এর মধ্যে জাকার্তায় অজস্র মানুষ বৃদ্ধি পেয়েছে, শহর বেড়েছে, কিন্তু পানীয় জলের ব্যবস্থা করা হয়নি সঠিকভাবে।

এখন অবস্থা এতটাই খারাপ যে ইন্দোনেশীয় সরকার জাকার্তা থেকে রাজধানী সরিয়ে বোর্নিওতে নিয়ে যাওয়ার কথা আলোচনা করছে। ২০১৪ সালে এক ডাচ আর্কিটেকচার কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি হয়ে ১২০ কিলোমিটার সামুদ্রিক দেওয়াল তৈরি করার। কিন্তু এখনও পর্যন্ত মাত্র ১০ কিমি তৈরি হয়েছে। তবে, দুঃখের বিষয় এটাই, শহরের মত দেওয়ালও আস্তে আস্তে ডুবে যাচ্ছে সমুদ্রের বুকে।

জাকার্তার এই সমস্যার একমাত্র সমাধান সমগ্র শহরে পাইপে করে পানীয় জল সরবরাহের ব্যবস্থা। কিন্তু অবস্থা এখন এতটাই হাতের বাইরে বেরিয়ে গিয়েছে যে তা কতটা সম্ভব হবে এই নিয়ে সরকার ধন্দে। ইতিমধ্যে, অসহায় মানুষ শুধু তাকিয়ে রয়েছে সমুদ্রের দিকে, এই প্রার্থনায়, কাল যেন মাথা গোঁজার আশ্রয়টুকু চলে না যায়।