জাতীয়

করোনার মতো গুরুত্ব না পাওয়ায় ভয়াবহ হয়েছে ডেঙ্গু


Warning: strlen() expects parameter 1 to be string, array given in /home/khalinews/public_html/wp-includes/functions.php on line 262
(Last Updated On: )

করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রমণ নিয়ে দেশ ও দেশের মানুষ যতটা উদ্বিগ্ন ছিল, ডেঙ্গু সংক্রমণ নিয়ে তার আংশিকও ছিল না বলে জানিয়েছেন রোগতত্ত্ববিদ ও বিশেষজ্ঞরা। তাদের দাবি, সরকার যেমন শুরুতে ডেঙ্গু মোকাবিলায় যথাযথ পদক্ষেপ নিতে পারেনি, সাধারণ মানুষের মধ্যেও কোনো সচেতনতা বা ভয় দেখা যায়নি, যে কারণে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে ডেঙ্গু সংক্রমণ। এমনকি এক সময়ের ঢাকার ডেঙ্গু এখন ঢাকার বাইরেও ব্যাপক আকারে বিস্তার লাভ করেছে।

শনিবার (২৫ নভেম্বর) দুপুরে রাজধানীর জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে (নিপসম) এপিডেমিওলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ আয়োজিত “ডেঙ্গুর বর্তমান পরিস্থিতি এবং উত্তরণের উপায়” শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এসব কথা বলেন।

অনুষ্ঠানের শুরুতেই ডেঙ্গু সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মোশতাক হোসেন।

তিনি বলেন, এডিস একদিন কামড়ালে ৪ দিন পর আবার কামড়ায়। একটি এডিস মশা যদি ৫০ দিন বেঁচে থাকলে তার লাইফটাইমে পর পর ১০ বার কামড়ায়।

মোশতাক হোসেন বলেন, মে, জুন, জুলাই এই তিন মাসে এডিসের প্রজনন হার অনেকটাই বেশি। এই সময়টাতে বৃষ্টিও বেশি হয়। কাজেই আমরা যদি মশা নিয়ন্ত্রণ করতে চাই, তাহলে এই সময়ে আগেই মশা নিয়ন্ত্রণের কাজটা করতে হবে। কিন্তু আমরা সময়মতো যথাযথ পদক্ষেপ নিতে পারিনি। ডেঙ্গু সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি।

তিনি বলেন, ডেঙ্গুর চারটি সেরোটাইপ রয়েছে। তবে এ বছর আসরা ডেন-২ এবং ডেন-৩ সেরোটাইপটা বেশি পেয়েছি। ইতোমধ্যে সারাদেশে ডেঙ্গু ছড়িয়ে গেছে, তবে ডেঙ্গু শনাক্ত এবং ডেঙ্গুতে মৃত্যুর ক্ষেত্রে ঢাকায় এবং বাইরে প্রায় সমান হয় গেছে। একটা সময় ছিল ঢাকাতে সবচেয়ে বেশি রোগী, এখন প্রায় সমান হয়ে গেছে। ২০২৩ সালের আউটব্রেকে আমরা দেখছি ঢাকা শহরের প্রায় সব এলাকাতেই ডেঙ্গু রোগী।

মোট সংক্রমণের ৩৫ শতাংশই ঢাকা এবং ৪৪ শতাংশ ঢাকার বাইরে থেকে আসছেন। এমনকি ৮৬ শতাংশ রোগী শনাক্ত হয়েছে হাসপাতালের চারপাশে দুই কিলোমিটারের মধ্যে।

আলমগীর বলেন, করোনার সময় থেকে আমরা কমিউনিটি এঙ্গেজমেন্টের বিষয়ে চেষ্টা করেছি, কিন্তু এই বিষয়টাতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। ডেঙ্গু প্রতিরোধেও আমাদের কী কী করতে হবে আমরা সবাই জানি, কিন্তু মানি না। এখানেই হচ্ছে আমাদের মূল সমস্যা। ডেঙ্গু সংক্রমণের সেই শুরু থেকে আমরা বিভিন্ন ধরনের মিটিং-সেমিনার করেছি, কিন্তু এভাবে আমরা মিটিং করলে কী হবে? আমি আজ পর্যন্ত জানি না স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে কোনো ধরনের টাস্কফোর্স কমিটি হয়েছে কি না। এক-দুইটা টেকনিক্যাল কমিটি হয়েছে, যার সর্বমোট মিটিং হয়েছে মাত্র তিনটা।

তিনি বলেন, ডেঙ্গু সংক্রমণ নিয়ে পূর্বেই তৈরি করা একটা ন্যাশনাল স্ট্রেটেজি করা হয়েছিলো, সেটা রিভিশনের জন্য আমরা বিভিন্ন ধরনের এক্সপার্ট অফার করেছি, সেটাও হয়নি। আমরা বলেছি তাহলে আপনারা ডেভেলপমেন্ট পার্টনারদের যুক্ত করেন, কারণ ডেঙ্গুতে প্রতিদিনই ডাবল ডিজিটের মানুষ মারা যাচ্ছে। আমরা ডেঙ্গু প্রতিরোধে কোনো কন্ট্রোল প্রোগ্রাম দেখিনি। অথচ আমরা সবাই বিচ্ছিন্নভাবে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কাজ করেছি।

ক্লিনিক্যাল ম্যানেজমেন্ট গাইডলাইন নিয়ে আমরা যখন হাসপাতালগুলোতে কথা বলতে গিয়েছি, আমরা দেখেছি কমিউনিটি লেভেলে ট্রিটমেন্ট করার কোনো গাইডলাইন নেই। আমাদের ৮০ পেজের একটা গাইডলাইন আছে, যেটা অধিকাংশ ডাক্তারের ট্রিটমেন্টের সময় ফলো করা সম্ভব নয়। তখন আমরা ছোট করে একটা পকেট গাইডলাইন তৈরি করেছি, সেখানেও এখন পর্যন্ত যথেষ্ট তত্ত্ব-উপাত্ত এবং ক্লিনিক্যাল এক্সপেরিয়েন্সের অভাব রয়েছে। সেটা রিভিশনের জন্য বারবার বলা হলেও সেটা হচ্ছে না।

তিনি আরও বলেন, এত বড় একটা আউটব্রেক, ১৫০০ জনের অধিক মানুষ মারা গেল, প্রতিদিন ডাবল ডিজিটের মানুষ মারা গেল, অথচ সেটা নিয়ে আমরা কোনদিন ইমারজেন্সি একটা মিটিং ডাকিনি। এ বিষয়গুলো আমাদের ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে অনেকটাই পিছিয়ে দিয়েছে।

এসময় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (জনস্বাস্থ্য) ডা. মো. আক্তারুজ্জামান বলেন, ডেঙ্গুতে কোনো মৃত্যুই আমরা প্রত্যাশা করি না। যার একমাত্র আয়-রোজগারের মানুষটি মারা যায়, তারাই একমাত্র ভয়াবহতাটা বুঝতে পারে। এজন্য ডেঙ্গু প্রতিরোধে সবাইকে একত্রে কাজ করতে হবে।

আমরা প্রত্যেকেই আলাদা আলাদাভাবে কাজ করছি, আমাদেরও যথেষ্ট গ্যাপ রয়েছে। আমার কাছে মনে হচ্ছে ডেঙ্গু নিয়ে আমরা আলোচনার টেবিলেই আটকে আছি। ডেঙ্গু সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করতে হলে আমাদেরকে মাঠ পর্যায়ে যেতে হবে। হল রুম সেমিনারে বসে শুধু গবেষণা আর বক্তব্য দিলেই হবে না।

তিনি বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, সিটি করপোরেশন এবং স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়সহ সবাইকে নিয়ে যৌথ কমিটি করে আমাদের কিছু ডকুমেন্টস বানাতে হবে। কাজের স্ট্রাকচার আগে থেকেই প্রস্তুত থাকবে। আমাদের আগে থেকেই অ্যাকশন প্ল্যান থাকবে। অনুযায়ী আমরা যদি কাজ করতে পারি, তাহলেই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।

ডেঙ্গুতে হাসপাতালগুলোতে নানা সংকট প্রসঙ্গে এই কর্মকর্তা বলেন, আমি ব্যক্তিগতভাবে বিভিন্ন হাসপাতালে ঘুরেছি। যে সমস্যাটা পেয়েছি সেটি হলো, আমাদের সরবরাহ শেষ হয়ে যাওয়ার পরই নতুন করে পাওয়ার বিষয়ে আমরা সক্রিয় হয়েছি। কিন্তু একটা বিষয় আমাদের মাথায় রাখা উচিত, লজিস্টিক সাপোর্ট ও সিস্টেমের কারণে আমাদের সরবরাহ কার্যক্রম অনেক সময় ব্যাহত হতে পারে। এজন্য আমরা যা ব্যবহার করবো, সেখান থেকে অন্তত ১০ শতাংশ সবসময় নিজের হাতে স্টক রাখতে হবে।

অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্যে এপিডেমিওলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি ও নিপসম পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, আমরা সবাই সমালোচনা করতে পারি এটা হচ্ছে না, ওটা হচ্ছে না। আমাদের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো হিউম্যান রিসোর্স। আমাদের যে হারে রোগী বেড়েছে, সেই অনুপাতে আমাদের তো হাসপাতালগুলোতে জনবল নেই। আমাদের নানা সীমাবদ্ধতা আছে, তারপরও আমি আশাবাদী।

তিনি বলেন, কিছু বিষয়ে আমরা হতাশ হই, এই যে আমরা এতকিছু করছি, আমাদের চিকিৎসকরা রাতদিন কাজ করছে, তারপরও ভালো ফলাফল আসছে না। এখনও সিটি করপোরেশন থেকে ডেঙ্গু প্রতিরোধে কী করণীয় সেটি নিয়ে মাইকিং করতে হচ্ছে, পত্রিকা-টেলিভিশনগুলোতে সচেতনতামূলক বিজ্ঞাপন দিতে হচ্ছে। এরপরও তো কোনো কাজে আসছে না।

কোভিডে মাস্ক পড়ুন বলতে বলতে মুখে ফেনা উঠে গেছে, তারপরও আমরা পারিনি। মশা উৎপাদন হবে এরকম স্থান থাকার কারণে জরিমানা করা হচ্ছে, তারপরও কাজ হচ্ছে না। আমরা আমাদের স্বভাব পরিবর্তন করার চেষ্টাও করি না। একটা এডিস ২০০ মিটার পর্যন্ত উড়তে পারে, তাই যদি হয়, তাহলে কি শুধু আমি পরিস্কার থাকলেই হবে? আমার অফিসের আশেপাশে অনেকগুলো ভাঙা গাড়ি পরে আছে, সেগুলোতে পানি জমে থাকে, সেগুলোর দায়িত্ব কে নেবে?

ডা. ফ্লোরা বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় মনে করে শুধু রোগী দেখার দায়িত্ব আমাদের, আবার কেউ বলছে টিকা আসলেই সমস্যা সমাধান হবে, তাহলে কি টিকা না আসা পর্যন্ত আমরা বসে থাকবো? আগামী দিনে ডেঙ্গু মোকাবিলায় আমাদের অবশ্যই সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে।

নিপসম পরিচালক বলেন, আমাদের এপিডেমিওলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের অ্যাক্টিভ অন্তত ২০০ জনের বেশি রোগতত্ত্ববিদ আছে, আমরা কতজনকে কাজে লাগাতে পারছি? কোভিডে একটা পরামর্শ কমিটি করেছিলাম, কিন্তু ডেঙ্গুতে এত মানুষ আক্রান্ত মৃত্যু হওয়ার পরও আমাদের কোনো পরামর্শক কমিটি করতে পারিনি।