প্রধান পাতা

‘তুই’ বললেও খুন করে কিশোর গ্যাং


Warning: strlen() expects parameter 1 to be string, array given in /home/khalinews/public_html/wp-includes/functions.php on line 262
(Last Updated On: )

গাজীপুরের গাছা থানাধীন তালেব মার্কেটের সামনে সোনাপাড়া এলাকায় মো. হাবিবুল্লাহর নেতৃত্বে ১৮ থেকে ২০ জন কিশোর ও যুবক প্রতিদিনের মতো আড্ডা দিচ্ছিল। এ সময় সেখানে শাকিল মিয়া (১৭) ও মো. ফাহিমের (১২) সঙ্গে তাদের কথাকাটি হয়। এর জের ধরে সংঘর্ষ হয় দু’পক্ষে। একপর্যায়ে প্রতিপক্ষরা শাকিল ও ফাহিমকে এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাত করে পালিয়ে যায়। স্থানীয়রা গুরুতর আহত অবস্থায় দুজনকে তায়েরুন্নেছা মেমোরিয়াল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে শাকিলকে মৃত ঘোষণা করেন কর্তব্যরত চিকিৎসক। আহত ফাহিমকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় পাঠানো হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।

ঘটনাটি গত ১২ এপ্রিলের। গাজীপুর মহানগরে এভাবেই সামান্য কথা কাটাকাটির জেরে প্রায়শই খুন হচ্ছে কিশোর-যুবক। যার নেপথ্যে রয়েছে কিশোর গ্যাং। শাকিলের মৃত্যুর ঘটনার পর পুলিশ প্রতিপক্ষ কিশোর গ্যাং সদস্য মো. হাবিবুল্লাহকে (২৫) আটক করে। এ ঘটনাটি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে গিয়ে বের হয় গাজীপুর মহানগরের আরও বেশ কিছু খুন-হত্যাকাণ্ডের ঘটনা। যার পেছনে সিংহভাগ কিশোরদের সম্পর্ক বেশি। সামান্য ‘তুই’ বললেও খুন করছে কিশোর গ্যাং।

মহানগর ছাড়াও গাজীপুর মেট্রোপলিটন এলাকার ৮ থানা এলাকায় আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে খুন, অপহরণ, চাঁদাবাজি, মাদক সিন্ডিকেট। গত ৫ মাসে ১০ খুন এবং ৪টি অপহরণের ঘটনা ঘটেছে। এই পরিসংখ্যান শুধুমাত্র পুলিশের কাছে হওয়া অভিযোগের ভিত্তিতে। জিএমপির ৮ থানা এলাকায় প্রতিদিন কমপক্ষে ৩০ থেকে ৪০টির বেশি অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ঘটে বলে স্থানীয়দের অভিযোগ রয়েছে। যার বেশির ভাগই কিশোর গ্যাং দ্বারাই সংঘটিত হচ্ছে।

শাকিল মিয়া হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে জানতে গিয়ে সাদেক আলী (৩০) নামে এক যুবকের খুনের বিষয় সামনে আসে। পুলিশের কাছে এ ঘটনায় করা অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছর ৪ ফেব্রুয়ারি গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মধ্য ছায়াবীথি এলাকায় রাত ১০টার দিকে মাদক ব্যবসার আধিপত্য নিয়ে পূর্ব-বিরোধের জের ধরে সাদেক আলীকে হত্যা করা হয়। মহানগরের পশ্চিম ভূরুলিয়া এলাকার শফিকুল ইসলামের ছেলে কাওসার আহমেদ (২৫) এ ঘটনা ঘটিয়েছেন বলে এলাকাবসীর অভিযোগ রয়েছে। একই দিন মহানগরীর মোগরখাল এলাকায় গৃহবধূ নীলা খাতুনকে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় নীলার মা রত্না বেগম ও স্বামী নয়ন মিয়াকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

জিএমপির কাশিমপুরে পরকীয়ার জেরে খুন হন সুমন মোল্লা। স্ত্রী আরিফা বেগম প্রেমিক তন্ময় সরকারকে সঙ্গে নিয়ে স্বামীকে হত্যা করে বলে পুলিশের কাছে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে। ১৯ এপ্রিল সুমনকে খুন করার পর নৃশংসভাবে লাশ ৬ টুকরো করে ফেলে দেয় অভিযুক্তরা।

গত ৮ মার্চ গাজীপুরের জয়দেবপুর থানার পিরুজালী বকচরপাড়া গ্রামে বিপ্লব হোসেন (১৫) নামে এক মাদ্রাসাছাত্রকে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। গত ৮ মে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের হাজীবাগ লেকভিউ আবাসিক এলাকা থেকে অজ্ঞাত (৪০) ব্যক্তির গলা কাটা লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। গত ১৬ মে গাজীপুর মহানগরের টঙ্গী দত্তপাড়া এলাকায় স্বপ্না আক্তার (৩৪) নামে এক গৃহবধুকে ছুরিকাকঘাতে হত্যা করে একই এলাকার সাইজ উদ্দিন (৬০)। পরকিয়ায় রাজি না হওয়ার খুন হন ওই গৃহবধু।

গাছা অঞ্চল থেকে দুই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে সংঘবদ্ধ অপহরণকারী চক্রের সদস্যরা। অপহরণে জড়িত শরিয়তপুর জেলার ভেদরগঞ্জ থানার পুটিয়া গ্রামের মৃত জব্বার সর্দারের ছেলে আলী আকবর (২৪) ও গাছা থানার দক্ষিণ খাইলকুরের মকবুল হোসেনের ছেলে আনোয়ার হোসেনকে (৩০) গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

কুড়িগ্রামের রাজীবপুর থানার মরিচাকান্দি এলাকার মো. মাহিম (১৮) একই এলাকার এক কিশোরীকে (১৬) নিয়ে গাজীপুরে আসেন। গাজীপুর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি কার্যালয়ের সামনে অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে কিশোরীকে অপহরণ করে দুর্বৃত্তরা। একদিন পর পুলিশ কিশোরীকে উদ্ধার করতে পারলেও অপহরণকারীরা রয়েছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।

গত ২৮ এপ্রিল মুক্তিপণ দাবিতে গাজীপুরে অপহরণ করা এক শিশুকে উদ্ধার করে নগরীর বাসন থানার পুলিশ। এ ঘটনায় জড়িত থাকার দায়ে সিরাজ নামে এক তরুণকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

এসব ঘটনার পেছনে যুবক-তরুণের সঙ্গে রয়েছে কিশোর অপরাধীরাও। কিছু ঘটনায় সরাসরি কিশোর গ্যাং সম্পৃক্ত। গাজীপুর মেট্রো সদর, কোনাবাড়ি, কাশিমপুর, বাসন, গাছা, পুবাইল থানা, টঙ্গী পশ্চিম ও টঙ্গী পূর্ব থানা এলাকায় এসব কিশোর গ্যাং ভয়ঙ্করভাবে সক্রিয়।

স্থানীয়দের অভিযোগ, এসব কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা কোনো না কোনোভাবে স্থানীয় প্রভাবশালী ‘বড় ভাই’দের ছত্রছায়ায় এলাকা দাপিয়ে বেড়ায়। এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, মানুষকে হয়রানি, মারধর বা রাজনৈতিক মিছিলে এসব কিশোর-তরুণদের কাজে লাগান কথিত বড় ভাইয়েরা। স্কুল-কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা বিপজ্জনক কিশোর গ্যাং কালচারে জড়িয়ে পড়ায় অভিভাবকদের মাঝে আতঙ্ক বিরাজ করছে। দিন দিন এদের তৎপরতা বৃদ্ধি পাওয়ায় বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনও।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ৩ সেপ্টেম্বর গাজীপুর জেলা শহরের রাজদীঘির পাড় এলাকায় ‘তুই’ বলায় সমবয়সী বন্ধুদের হাতে খুন হয় নুরুল ইসলাম নুরু (১৬) নামে এক কিশোর। পার্শ্ববর্তী সাহাপাড়ার ‘ভাই-ব্রাদারস’ গ্রুপের বেশ কয়েকজন সদস্য কিশোর নুরুকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে উপর্যুপরি কুপিয়ে হত্যা করে। এ ঘটনায় র‌্যাব-১’র সদস্যরা হত্যাকাণ্ডে জড়িত কিশোর গ্যাং চক্রের ছয়জনকে গ্রেপ্তার করে। তাদের কাছ থেকে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত চাপাতি ও ছোরা উদ্ধার করা হয়।

গত ৭ জুলাই ২০২০ গাজীপুর মহানগরীর টঙ্গী পূর্ব থানাধীন ফকির মার্কেট এলাকায় আধিপত্য বিস্তার কেন্দ্র করে স্থানীয় ফিউচার ম্যাপ স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্র শুভ আহাম্মেদকে (১৬) বুক, পিঠ ও মাথায় উপর্যুপরি কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় র‌্যাব-১, প্রধান আসামি ও কিশোর গ্যাং লিডার মৃদুল হাসান পাপ্পুসহ ‘পাপ্পু লিডার’ গ্রুপের চারজনকে গ্রেপ্তার করে। তারা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। এ ঘটনার কয়েক দিন পর ২৪ জুলাই একই থানাধীন কাজী পাড়া চন্দ্রিমা এলাকায় বাসায় ঢুকে তৌফিজুল ইসলাম ওরফে মুন্না (১৫) নামে এক স্কুল শিক্ষার্থীকে খুন করা হয়। মুন্না রাজধানীর বিএফ শাহিন একাডেমির অষ্টম শ্রেণির ছাত্র ছিল। এ ঘটনায় পুলিশ মুন্নার ব্যবহৃত মোবাইল সেট উদ্ধার করলেও হত্যাকাণ্ডের মূল অপরাধীকে এখনো শনাক্ত করতে পারেনি।

গাজীপুর মহানগরীর পূবাইল মেট্রোপলিটন থানার মীরের বাজারে কাকা ডেকে নাসির পারভেজ (৩৩) নামে আওয়ামী লীগ নেতাকে ছুরিকাঘাত করে প্রায় আড়াই লাখ টাকা ছিনতাই করে দুর্বৃত্তরা। নাসির পারভেজ বাদী হয়ে কিশোর গ্যাং লিডার তনয় আহমেদের (১৮) নাম উল্লেখ করে আরও ৩-৪ জনকে আসামি করে মামলা করেন। অভিযুক্ত প্রধান আসামি তনয় আহমেদ (১৮) মহানগরীর ৪২ নম্বর ওয়ার্ডের হারবাইদ মাদ্রাসা এলাকার আকতার হোসেনের ছেলে।

জানা গেছে, টঙ্গী নদীবন্দর এলাকায় তুরাগ নদের তীরে হাঁটার পথ, ঢাকা ডাইংয়ের পেছনের দিকসহ আশপাশের এলাকায় সারাক্ষণই থাকে কিশোরদের আড্ডা। ১২ থকে ১৪টি দল এখানে গড়ে উঠেছে। একেকটি দলে ৮ থেকে ১০ জন করে সদস্য থাকে। স্থানীয়দের অভিযোগ টঙ্গীর পাগাড় এলাকায় মো. পারভেজ ও মনির ওরফে ব্লাকেট মনির গ্রুপ সক্রিয়। পাগাড় আলেরটেকের মিলন হত্যা মামলার প্রধান আসামি মনির। মিলন হত্যার ঘটনায় পরে পারভেজকেও গ্রেপ্তার করা হয়। এর বাইরে ওই সব কিশোরের অনেকে হাবিবুর হত্যা মামলার আসামি।

টঙ্গীর ব্যস্ততম বিসিক ও নতুনবাজার এলাকায় নেতৃত্ব দেন মো. শুক্কুর আলী নামের এক ব্যক্তি। বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। টঙ্গীর আরেক এলাকা এরশাদনগর। অনুসন্ধানে দেখা যায়, আটটি ব্লকে বিভক্ত এ এলাকায় ছোট-বড় ছয় থেকে সাতটি বাহিনী রয়েছে। এর মধ্যে ছাত্রলীগের জুয়েল, অন্তর ও যুবলীগের আমির হামজার উৎপাত সবচেয়ে বেশি।

বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, কিশোর গ্যাং গ্রুপের সদস্যরা দলবদ্ধভাবে নগরের বিভিন্ন স্পটে জড়ো হয়। রাজবাড়ি মাঠে ও বাউন্ডারীর দক্ষিণ পাশে, জোর পুকুরের উত্তর ও পূর্ব পাড়, দক্ষিণ ছায়াবিথী-হাড়িনাল রোডের কালভার্টে, লালমাটি, শ্মশান ঘাটে, বারেকের টেক, ফুলস্টপের গলি, বরুদা, ছায়াবিথী, রথখোলা, ভোড়া, হাজীবাগ, কাজীবাড়ি, পূর্ব চান্দনা, নীলের পাড়া রোড, পশ্চিম জয়দেবপুর (লক্ষীপুরা), মারিয়ালী, কলাবাগান, দেশীপাড়া, ভূরুলিয়ার ময়লার টেক, ডুয়েট ও রয়েল ইনস্টিটিউটকেন্দ্রিক আশপাশের এলাকা, এটিআই গেট, শিমুলতলী বাজারসংলগ্ন উত্তর পাশে, চতর স্কুল গেট, ফাউকাল রেলগেট এলাকা, কাউলতিয়া, চান্দনা, কোনাবাড়ী, কাশিমপুর, পূবাইল, গাছার বিভিন্ন এলাকায় ছোটো-বড়ো কিশোর গ্যাং গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। এদের মধ্যে আধিপত্য বিস্তার, মাদক, নারীকাণ্ড, স্ট্যান্ড দখল, সিনিয়র-জুনিয়রসহ নানা ধরনের ছোটোখাটো বিষয় নিয়ে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া, মারামারি ও খুন খারাবির ঘটনাও ঘটছে।

এ ছাড়া বিভিন্ন স্কুল-কলেজের মোড়ে বা অলি-গলির চা দোকানের পাশে দাঁড়িয়ে প্রকাশ্য ইভটিজিং এবং বীরদর্পে সিগারেট ফুঁকলেও কেউ কিছু বলার সাহস করে না। ১৩ থেকে ১৯ বছরের এসব কিশোর বিভিন্ন স্কুল কলেজের শিক্ষার্থী বা স্কুলছুট। কিশোরদের কেউ স্কুল থেকে ঝরে পড়া, কেউ বা স্কুলেই যায়নি। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এসব কিশোরের অধিকাংশই দরিদ্র পরিবারের। কারও বাবা রিকশা চালান, কারও বাবা চা বিক্রি করেন, আবার কারও মা-বাবা গৃহকর্মীর কাজ করেন। অপরদিকে মহানগরের অপর ৬ টি থানায়ও কিশোর গ্যাং কালচার এবং উঠতি ওইসব কিশোরের দৌড়াত্ম বেড়েই চলেছে।

এ বিষয়ে জানতে জিএমপির উপপুলিশ কমিশনার (অপরাধ দক্ষিণ) মো. জাকির হোসেন আমাদের সময়কে বলেন, ‘জিএমপিতে কিশোর গ্যাং রয়েছে বলে তিনি মনে করেন না। তবে কিশোর অপরাধী আছে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে। তা ছাড়া জিএমপি কমিশনারের নির্দেশে নিয়মিত প্রতিটি থানায় কিশোর ও অভিভাবকদের সাথে কাউন্সিলিং করা হয়। এতে অনেকটাই সুফল পাওয়া গেছে।’

গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মো. লুৎফুল কবিরের কাছে জানতে চাইলে আমাদের সময়কে তিনি বলেন, ‘অপরাধ সংঘটনের পর পুলিশ যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে প্রতিকারের ব্যবস্থা করেছে।’ আইনশৃঙ্খলার অবনতি হচ্ছে কিনা প্রশ্ন করলে ‘তা হচ্ছে না’ বলে তিনি জানান।