আন্তর্জাতিক

পাকিস্তানে জাতিগত বাঙালিদের দুর্দশা


Warning: strlen() expects parameter 1 to be string, array given in /home/khalinews/public_html/wp-includes/functions.php on line 262
(Last Updated On: )

পাকিস্তানেই জন্ম তাদের। সমস্যা হলো তারা জাতিগত বাঙালি। তাই আজো জোটেনি তাদের সরকারি স্বীকৃতি কিংবা নাগরিকত্ব।

কিরণ জাফর এবং কুলসুম ইয়ামির পাকিস্তানের দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর করাচির দু’জন কিশোর জিমন্যাস্টের নাম। তারা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের প্রতিনিধিত্ব করার আশা করছে। কিন্তু দুজনেই জানে, এই স্বপ্ন পূরণের কোন সুযোগ তাদের সামনে নেই। তারা পাকিস্তানে রাষ্ট্রহীন, অসহায় বাঙালি। কোনরূপ সরকারি শনাক্তকরণ দলিল ছাড়া তারা কেবল এমন স্বপ্নই দেখতে পারে, সেটা নিয়ে সামনে এগুতে পারে না।

১৫ বছর বয়সী জাফর এবং চৌদ্দ বছর বয়সী ইয়ামির করাচির সবচেয়ে বড় বস্তি মাচার কলোনিতে থাকে। এটি আনুমানিক ৭০০,০০০ লোকের একটা অতি ঘন বসতি। এমন বস্তিতে বসবাসের একটাই অর্থ- এখানকার বাসিন্দারা ঘিঞ্জি ঘরবাড়ি, অসমাপ্ত, ভঙ্গুর রাস্তাঘাট, নি¤œ স্বাস্থ্য-সুবিধাসহ নিদারুণ দারিদ্র্যের মধ্যেই দিনাতিপাত করছে। স্থানীয় দাতব্য প্রতিষ্ঠান ‘ইমকান কল্যাণ সংস্থা’র পরিচালক আইনজীবী তাহেরা হাসানের মতে, মাচার কলোনির প্রায় ৬৫ শতাংশ অধিবাসী জাতিগত বাঙালি এবং তাদের অর্ধেকেরও বেশির নাগরিকত্ব বা অন্য কোনও কাগজপত্র নেই। তারা একটি জটিল প্রক্রিয়ার ভেতর আটকে আছে। তাই না পারছে তারা সন্তানদের একটা স্কুলে ভর্তি করাতে, কিংবা ব্যাংকে একটা হিসাব খুলতে। মোটকথা মৌলিক সুবিধা-বঞ্চিত এসব বাসিন্দাদের স্বপ্নগুলো অংকুরেই যেন ঝরে যেতে বসেছে।

চরম দারিদ্র্যে বেড়ে ওঠা
এখানে চরম দারিদ্র্যের ভেতর বেড়ে ওঠা শিশুদের জন্য এক টুকরো ‘রঙিন জগত’ই যেন ‘খেল’ নামের শিক্ষা, খেলাধুলা ও বিনোদননির্ভর প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটি। এখানে জাফর ও ইয়ামিরের মতো ১৭০ জন সুবিধাবঞ্চিত শিশুকে নানা ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। এখানে প্রথাগত শিক্ষার পাশাপাশি শিশুদের সংগীত, খেলাধুলার (বিশেষত জিমনাস্টিক্স) নানা কলাকৌশল শেখানো হয়। গত পাঁচ বছর ধরে এই শিশুদের প্রশিক্ষণ দিয়ে আসা কোচ মুহাম্মদ ফুরকান বলেন, “এই শিশুদের জিমন্যাস্ট হিসেবে প্রশিক্ষণ দেওয়া একটি বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। তারা সবাই চরম দারিদ্র্যের মধ্যে বড় হয়েছে। এমনকি তারা তাদের জীবনে কখনো পার্কও দেখেনি। এই ধরনের কষ্টের মধ্যে বসবাস করে আসা এই শিশুরা জানেই না যে ‘সহানুভূতি’ এবং ‘জিমন্যাস্টিকস’ আসলে কী জিনিস।

পাকিস্তানে জাতিগত বাঙালি রয়েছে আনুমানিক বিশ লাখের মতো। তারা এখানে সবচেয়ে বৈষম্যমূলক জাতিগত সম্প্রদায়। তাদের অনেকেই ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের আগে থেকেই পাকিস্তানে বসবাস করে আসছেন। আবার তাদের অনেকেরই পাকিস্তানেই জন্ম। অথচ জাতিগত এই বাঙালিরা এখনো কোনরূপ সরকারি স্বীকৃতি কিংবা নাগরিকত্ব-সনদ থেকে বঞ্চিত। তারা ভোট দিতে পারে না বা জনস্বাস্থ্যসেবা বা সরকারি স্কুলে প্রবেশাধিকার পায় না। পাকিস্তান বেঙ্গলি অ্যাকশন কমিটির চেয়ারম্যান শেখ মুহাম্মদ সিরাজ অনুযোগের সুরে বলেন, “তারা আমাদের এলিয়েন, শরণার্থী কিংবা বিদেশি বলে অভিহিত করে; আমাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে রেখেছে। কিন্তু আমরা এই দেশে স্বীকৃতি পেতে নিরন্তর সংগ্রাম করে যাচ্ছি। কেননা আমরা বাঙালি ঠিকই, কিন্তু আমরা পাকিস্তানি বাঙালি।

ডিজিটালাইজেশন প্রক্রিয়া
প্রাথমিকভাবে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পর যেসব বাঙালি পাকিস্তানে থেকে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তাদের প্রথম ম্যানুয়াল আইডি কার্ড দেওয়া হয়েছিল, যেটা ১৯৭৩ সালে এবং তারপরে বিলি করা হয়েছিল। কিন্তু এ জনসংখ্যার প্রধান সমস্যাটি আইডি কার্ডের ডিজিটালাইজেশন এবং ২০০০ সালে ন্যাশনাল ডাটাবেস এন্ড রেজিস্ট্রেশন অথরিটি (ন্যাড্রা) প্রতিষ্ঠার পর শুরু হয়েছিল।

আইনজীবী তাহেরা হাসান বলেছেন, ডিজিটালাইজেশন প্রক্রিয়ায় ডকুমেন্টেশনের প্রয়োজনীয়তা পরিবর্তিত হয়ে যায়। ফলে সব নাগরিকের পক্ষে সরকারের চাওয়া যাবতীয় তথ্য সরবরাহ করা কঠিন হয়ে পড়ে। ঠিক এ সময়েই অভিবাসী এবং বিদেশি বাসিন্দাদের নিবন্ধন করার জন্য গঠিত হয় ‘নারা’ (ন্যাশনাল এলিয়েন রেজিস্ট্রেশন অথরিটি)। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এতো আগে থেকে দেশটিতে বসবাস করে আসা সত্ত্বেও বাঙালি জনগোষ্ঠী ‘এলিয়েন’ বিবেচিত হয়। ফলে তারা পায় ‘নারা’ কার্ড। শুরু হয় পদ্ধতিগতভাবে বাংলাভাষী জনগোষ্ঠীর সাথে বৈষম্যমূলক আচরণ। এমনকি আগের পাকিস্তানি পাসপোর্ট এবং আইডি কার্ডধারী বাঙালি যারা ছিলেন, তাদেরও পরবর্তীতে জোর করে নারা কার্ড ধরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এ বাঙালি সম্প্রদায়কে জোর করে ‘নারা’ বায়োমেট্রিক নিতে বাধ্য করা হয়েছিল, অর্থাৎ স্বয়ংক্রিয়ভাবে তাদের নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়েছিল।

এভাবে ২০০২ থেকে আইডি কার্ডধারী বাঙালিদের কার্ডগুলো ব্লক করা শুরু হয় এবং এগুলো ‘বিদেশি মামলা’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ২০১৫ সালে যদিও ‘নারা’ ‘নাদ্রা’র সাথে একীভূত হয়েছিল, কিন্তু বাঙালি নাগরিকদের আইডি কার্ড সংক্রান্ত সমস্যাটি এখনও কোন সমাধানে পৌঁছায়নি। ‘নারা’ ‘নাদ্রা’র সাথে একীভূতকরণ ‘এলিয়েন’ ক্যাটাগরির অধীনে পাকিস্তানে বসবাসকারী অ-দেশি এবং বিদেশিদের নিবন্ধনের সুবিধার্থে করা হয়েছিল; কিন্তু এতে করে বাঙালিদের ‘জন্মগত অধিকার আইন’র অধীনে প্রদত্ত নাগরিকত্ব পাওয়ার অধিকারকে সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করা হয়েছিল। এ ব্যাপারে এখনো ‘নাদ্রা কর্তৃপক্ষ’র সাড়া মেলেনি।

প্রধানমন্ত্রীও তাঁর প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেননি
২০১৮ সালে, নির্বাচনে জয়ের আগে, ইমরান খান পাকিস্তানে বাঙালিদের জাতীয় পরিচয়পত্র এবং নাগরিকত্ব দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘[বাঙালি] শিশু, যারা পাকিস্তানে জন্মগ্রহণ করেছে, এমনকি যাদের পূর্বপুরুষরাও কয়েক দশক ধরে দেশে বসবাস করছে এবং জন্মগত অধিকার সত্ত্বেও নাগরিকত্ব পাচ্ছে না, তার পিটিআই পার্টি জয়ী হলে, এ বাঙালিরা আইডি কার্ড পাবে । এটি শোষণ এবং সমস্যাটি অবশ্যই সমাধান করা উচিত।’

তিন তিনটি বছর পেরিয়ে গেলেও তা এখনও বাস্তবায়িত হয়নি। তিনি করাচির গভর্নর হাউসে এবং জাতীয় পরিষদেও এ কথা বলেছেন। কিন্তু তার সে প্রতিশ্রুতি আজো পূরণ হয়নি। পিটিআইয়ের সিনিয়র রাজনীতিবিদ এবং পাকিস্তানের মানবাধিকার বিষয়ক মন্ত্রী শিরীন মাজারির সাথে এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলেও তিনি মন্তব্য করতে রাজি হননি। অন্য একজন সিনিয়র পিটিআই নেতা শাফকাত মেহমুদ, ইমেলের মাধ্যমে যোগাযোগ করা হলে সাড়া দেননি। এমনকি বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শেখ রাশেদও তার সহকারীর মাধ্যমে কেবল সাফাই গেয়েছেন, ‘অনেক প্রযুক্তিগত দিকের কারণে বিষয়টি সম্পর্কে তার কোন ধারণা নেই।’

শিশুরা সবচেয়ে বেশি কষ্ট পাচ্ছে
জাফর এবং ইয়ামিরের পাশাপাশি তাদের বাবা-মাও পাকিস্তানে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ১৯৫১ সালের পাকিস্তানের নাগরিকত্ব আইন অনুসারে, আইনটি শুরু হওয়ার পর পাকিস্তানে জন্মগ্রহণকারী যে কোনও ব্যক্তির নাগরিকত্ব দাবি করার অধিকার রয়েছে।

জাফর এবং ইয়ামিরের পরিবারের সদস্যদের কারোরই আইডি কার্ড নেই। তাদের জন্য জাতীয় পর্যায়ে প্রতিযোগিতা করা বা আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব করা তাই অসম্ভব।

আইনজীবী তাহেরা হাসানের মতে, পাকিস্তানে জন্মগত অধিকারের আইনটি অন্যতম প্রগতিশীল আইন হিসেবেই বিবেচিত। এটি মোটেই বৈষম্যমূলক নয়। মূল সমস্যাটি বাস্তবায়নের স্তরেই। ফলে এই শিশুরাই সবচেয়ে বেশি কষ্ট পাচ্ছে। নাগরিকত্ব নিশ্চিতকারী কোন আইনি দলিল ছাড়া তারা পাবলিক স্কুলে ভর্তি হতে পারে না। তাদের যথাযথ শিক্ষা, বা অনুরূপ কিছু অর্জনের সম্ভাবনাগুলি অচল হয়ে পড়েছে।

একজন প্রহরী হিসেবে কাজ করে এমন দরিদ্র স্বামীর সাথে থেকেও জাফরের মা তার শিশুদের জন্য একটা উজ্জ্বল জীবনের প্রত্যাশা করেন। ছেলে নেই বলে তার কোনও আক্ষেপ নেই। মেয়ে তার জিমন্যাস্টিক্স খুবই পছন্দ করে; আর এতে সে বেশ ভালও করছে। তাই তারা তাকে আন্তরিকভাবেই সমর্থন করছেন।

শেষকথা
স্থানীয় সমাজকর্মী ও আইনজীবী রানা আসিফ হাবিব পাকিস্তানে বাঙালি সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের এখন পর্যন্ত কোন তৎপরতা দেখা যায়নি বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘এমনকি আন্তর্জাতিক মানবিক সংগঠনগুলোও এই চাপা সমস্যাটিকে স্বীকৃতি দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। পাকিস্তান মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাপত্র, নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারের আন্তর্জাতিক চুক্তি এবং শিশু অধিকার বিষয়ে জাতিসংঘের কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী। তবুও, সরকার এই আন্তর্জাতিক চুক্তি মানছে না এবং এখানকার বাঙালিরা এখনও লড়াই করছে।
পাকিস্তানে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান আসাদ ইকবাল বাটও স্বীকার করেছেন, এদেশে একজন অবাঙালি শ্রমিক যেখানে মাসে ১২-১৩ হাজার রুপি মজুরি পায়, একজন বাঙালি পায় তার অর্ধেক। তাছাড়া বাঙালি মেয়েরা ফ্যাক্টরি, বাসাবাড়িতে কাজ করে শুধু যে পয়সা কম পায় তা নয়, যৌন নিপীড়নের শিকারও হচ্ছে তারা।

স্থানীয় বাঙালি নেতা জয়নুল আবেদিন মনে করেন, সস্তা শ্রমের সুবিধার জন্য পাকিস্তানে কেউ চায় না বাঙালিরা দেশ ছেড়ে চলে যাক, কিন্তু বৈধতার জন্য কেউ তাদের জন্য কিছু করছেও না। অথচ করাচির মৎস্য শিল্পের মেরুদ- এই বাঙালিরাই। আসল কথা হলো- বাঙালিরা নাগরিক নয়, সুতরাং তাদের ভোট নেই। ফলে, রাজনীতিকরাও তাদের নিয়ে মাথা ঘামায় না।

মানবাধিকার কমিশনের আসাদ আরো স্বীকার করেছেন, মূল সমস্যা হচ্ছে বাংলাদেশ সৃষ্টির পর পাকিস্তানে বাঙালিরা ঘৃণার শিকার হয়ে পড়ে। তাদেরকে ছোটো চোখে দেখা শুরু হয়, বিশ্বাসঘাতক হিসাবে দেখা শুরু হয়। রাখঢাক না রেখেই বৈষম্য শুরু হয়।
তবুও জাফর-ইয়ামিরের মা-বাবারা আশায় আছেন একদিন এ আঁধার কেটে যাবে। তারাও পাবেন নাগরিকত্ব, নিদেনপক্ষে একটা কার্ড- যেটা তাদের মৌলিক অধিকারসহ সব নাগরিক সুবিধাদির যোগ্য করে তুলবে।

[তথ্যসূত্র : আল জাজিরা, বিবিসি]