জাতীয়

বাজার ব্যবস্থাপনায় বাড়তি চাপে অসহায় মানুষ


Warning: strlen() expects parameter 1 to be string, array given in /home/khalinews/public_html/wp-includes/functions.php on line 262
(Last Updated On: )

করোনাকালে আয় কমেছে, বেড়েছে জীবনযাত্রার ব্যয়। মহামারীর ধকল কাটিয়ে উঠতে মানুষ যখন জীবনযুদ্ধে নেমেছে তখনই ধারাবাহিকভাবে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসহ সবকিছুর দামও হু হু করে বাড়ছে। প্রতি মাসে বাড়তি খরচ গুণতে গুণতে নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্তরা এমনিতেই দিশাহারা। এর মধ্যেই হঠাৎ বুধবার রাতে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম অন্তত ২৩ শতাংশ বাড়াল সরকার। দুশ্চিন্তা নিয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে দিন শুরুর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই এলপি গ্যাসের সিলিন্ডারের দাম বৃদ্ধির ঘোষণা শুনল দেশের মানুষ। বিশ্লেষকেরা বলছেন, জ্বালানির দাম বৃদ্ধির কারণে পরিবহন ব্যয় ও অন্যান্য পণ্যের উৎপাদন খরচও বাড়বে। ইতোধ্যেই জীবনযাত্রার বিভিন্ন ধাপে এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম
রহমান গতকাল বলেন, ডিজেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় বাস, ট্রাক ও লঞ্চসহ সব ধরনের পরিবহন খরচ বেড়ে যাবে। পরিবহন ব্যয় বাড়লে পণ্যের দামও বাড়বে। আর এলপিজি সিলিন্ডারের দাম বাড়াতে হোটেল, রেস্তোরাঁর খাবারের দামও বেড়ে যাবে। কেরোসিনের দাম বাড়াতে সবচেয়ে বেশি চাপে পড়বেন দরিদ্র মানুষেরা। জ্বালানির দাম বৃদ্ধিতে কৃষি খাতে কৃষকেরও খরচ বেড়ে যাবে। উৎপাদন ব্যয় বাড়লে বাজারেও তার প্রভাব পড়বে। সব মিলিয়ে গোটা জীবনযাত্রার এর বড় প্রভাব পড়বে। করোনাকালীন অর্থনৈতিক চাপের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এখন নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যের দাম মানুষকে ভোগাচ্ছে। এরই মধ্যে জ্বালানির দাম এত বেড়ে গেলে জীবনধারণের খরচ মেটাতে বড় রকমের চাপে পড়তে হবে সীমিত আয়ের মানুষদের।

গত বুধবার রাত ১০টায় পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ডিজেল ও কেরোসিনের মূল্য প্রতি লিটার ভোক্তা পর্যায়ে ৬৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৮০ টাকা করা হয়েছে। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) যুক্তি, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির দাম বাড়ার কারণে প্রতিদিন ডিজেল ও ফার্নেস তেল বিপণনে ২০ থেকে ২২ কোটি টাকার মতো লোকসান হচ্ছে।

বিপিসির তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর ৪০ লাখ টন ডিজেল আমদানি করতে হয় বাংলাদেশকে। অকটেন আমদানি করা হয় এক লাখ থেকে এক লাখ ২০ হাজার টন। প্রায় সমান পরিমাণ পেট্রোল উৎপাদন করা হয় দেশীয় উৎস থেকে। আগে পেট্রোল ও অকটেন বিপণনে বিপিসির মুনাফা থাকলেও এখন লোকসান হচ্ছে বলে কর্মকর্তারা জানান।

সরকারি সংস্থা বিপিসির লোকসান কমানোর এ উদ্যোগে নাগরিকদের মাথায় হাত। তারা বলছেন, সবজি খেয়ে বাঁচার দিনও শেষ। গত কিছুদিনে যেভাবে সবজির দাম বেড়েছে তাতে সবাই উদ্বিগ্ন। এখন আবার বেড়েছে জ্বালানির দাম। বাড়তি দামের আগুনে বাজারে যাওয়াই কঠিন হয়ে যাবে।

রাজধানীতে কারওয়ান বাজারের রিয়াদ এন্টারপ্রাইজের ব্যবসায়ী বলরাম চন্দ্র জানান, জ্বালানির দাম বাড়ায় ইতোমধ্যেই ট্রাক-পিকআপ ভ্যানের ভাড়া বেড়ে গেছে। শুক্রবার গাড়ি চললে ভাড়াও বাড়বে। রাজধানীতে সবজি আনতে আমাদের খরচ বেড়ে যাবে। এতে দামও বাড়াতে হবে। আমরা নিরুপায়।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বর্তমানে সবকিছুতে বাড়তি খরচ করতে হচ্ছে। এর মধ্যে ডিজেল, কেরোসিনের দাম বাড়ানোতে স্থির আয়ের মানুষ ও দরিদ্রদের ওপর চাপ বাড়াবে। বিশেষ করে সরকার কেরোসিনের দামটা কম সমন্বয় করতে পারত। কারণ দেশের অনেক দরিদ্র মানুষ কেরোসিনের ওপর নির্ভরশীল। এছাড়া জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি সেচ খরচসহ কৃষিখাতে ব্যয় বাড়াবে। এটাও একটা ভাবনার বিষয়। পরিবহন খরচও বাড়বে। তিনি আরও বলেন, জ্বালানির দাম সহনীয় রাখতে ভর্তুকি দিয়ে খুব একটা সুবিধা হবে না। আমদানিতে শুল্ক সমন্বয় করা যেতে পারে। পাশাপাশি বেসরকারি পর্যায়ে আমদানি করতে হবে।

ক্যাব সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির ক্ষেত্রে সরকারের আরও সহনশীলতার পরিচয় দেওয়ার দরকার ছিল। কিছু অংশের সুবিধা না দেখে সর্বাধিক মানুষ যেটিতে উপকৃত হবে সেদিকে নজর দেওয়া উচিত। আমরা আগেও আহ্বান জানিয়েছি, জ্বালানিতে ভর্তুকি দেওয়া যেতে পারে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ও দেশীয় বাজারের যে মূল্য সমন্বয়, সেটিও বাস্তবসম্মত নয়। এক লাফে দাম এতখানি বাড়াতে অসহনীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে।
দেশের অনেকগুলো বিদ্যুৎকেন্দ্র ডিজেলচালিত। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রকৌশলী বেলায়েত হোসেন বলেন, গ্যাসের দাম বেশি থাকায় বিদ্যুৎ উৎপাদনে তেলের দিকেই ঝুঁকতে হচ্ছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনে তেলের দামে সরকারকে হয় ভর্তুকি দিতে হবে, না হলে বিদ্যুতের দাম বাড়বে।

এদিকে গতকাল বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন- বিইআরসি তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) দাম সাড়ে চার টাকা বাড়িয়ে মূসকসহ ১০৯ টাকা ৪২ পয়সা নির্ধারণ করে। বাজারে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত ১২ কেজি ওজনের একটি সিলিন্ডারে দাম এখন মূসকসহ ১৩১৩ টাকা পড়বে। অক্টোবরে যা ছিল ১২৫৯ টাকা এবং সেপ্টেম্বরে ১০৩৩ টাকা ছিল। দফায় দফায় সিলিন্ডার গ্যাসের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় হোটেল, রেস্তোরাঁয় খাবারের দামও বাড়ছে। রাজধানীর অনেক রেস্তোরাঁর খাবারের দাম গতকালই ১০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। সকালের নাস্তায় পরোটার দামও কোথাও কোথাও এক টাকা বেশি রাখা হয়েছে। সবজির দামও চার থেকে পাঁচ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। ছাত্রাবাস ও কর্মজীবীদের হোস্টেলগুলোতেও খাবারের খরচ রাতারাতি বেড়ে গেছে।

করোনা পরিস্থিতিতে বেসরকারি ব্যাংকের চাকরি হারিয়ে দিশেহারা হাসনাইন আহমেদ উজ্বল। ফার্মগেট তেজতুরী বাজার এলাকার একটি মেসে থেকে এখন চাকরি খুঁজছেন তিনি। উজ্বল বলেন, মেসের সিট ভাড়া ৪০০ টাকা বেড়েছে, দুই বেলার খাবার বাবদ মাসে খরচ ৫০০ টাকা বেড়ে আড়াই হাজার টাকা হয়েছে। সকালে হোটেলে নাস্তা করতে হয়। সেখানেও ১০ টাকার ভাজি এখন ১৫ টাকা হয়েছে, ৫ টাকার পরোটা ৬ টাকা হয়েছে। এখন আবার শুনছি বাস ভাড়া বাড়তে পারে, খাবার খরচও বাড়বে। বেকার জীবনে আগামী দিনগুলো কিভাবে কাটবে ভেবে পাই না।

এলপিজির দাম বাড়াতে খাবারের দাম আরও বাড়বে বলে জানান বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির মহাসচিব ইমরান হাসান। তিনি বলেন, ৮০ শতাংশেরও বেশি রেস্তোরাঁ এলপিজির ওপর নির্ভরশীল। একদিকে ভোজ্যতেলসহ নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে, রেস্তোরাঁ পরিচালনা ব্যয়ও বেড়েছে। এরই মধ্যে এলপিজি সিলিন্ডারের দাম বাড়াতে খাবারের দাম স্বাভাবিকভাবেই বেড়ে যাবে।