জাতীয়

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পাচ্ছে এনআইডির দায়িত্ব!


Warning: strlen() expects parameter 1 to be string, array given in /home/khalinews/public_html/wp-includes/functions.php on line 262
(Last Updated On: )

এক যুগের বেশি সময় ধরে অভিজ্ঞতা অর্জন এবং নিজস্ব ব্যবস্থাপনা সমৃদ্ধ করার পর নির্বাচন কমিশন জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) নিবন্ধন কার্যক্রম এবং এসংক্রান্ত সেবার দায়িত্ব হারাতে বসেছে। প্রায় এক বছর আগে যে গুঞ্জন শোনা গিয়েছিল, সেটিই সত্য হতে চলেছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হাতে যাচ্ছে এনআইডি নিবন্ধন কার্যক্রম। এ মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগকে এনআইডি কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে গত ১৭ মে এ বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। চিঠির অনুলিপি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) পাঠানো হয়েছে।

সরকারের এই সিদ্ধান্তে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছেন নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা। গতকাল বুধবার বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশন নির্বাচন কমিশনারের কাছে দেওয়া এক স্মারকলিপিতে তাদের উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার কথা জানিয়ে এনআইডির দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের কাছে রাখতেই পদক্ষেপ নেওয়ার আবেদন জানিয়েছে। একই সঙ্গে অন্য প্রতিষ্ঠানের কাছে এনআইডির সেবার কাজ হস্তান্তর করা হলে ব্যাপক অর্থ ব্যয়ের আশঙ্কার কথাও উল্লেখ করা হয়েছে।

এদিকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের চিঠিতে ‘অ্যালোকেশন অব ডিফারেন্ট মিনিস্টারস অ্যান্ড ডিভিশনস’-এ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা বিভাগের দায়িত্বগুলোর মধ্যে জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন সংক্রান্ত সব কার্যক্রম অন্তর্ভুক্ত এবং জাতীয় পরিচয়পত্র আইন ২০১০ সংশোধন করে ‘নির্বাচন কমিশন’-এর পরিবর্তে ‘সরকার’ শব্দ অন্তর্ভুক্ত করাসহ আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধনীর কথা বলা হয়।

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিচালক-১০ এ কে এম ফজলুর রহমান স্বাক্ষরিত চিঠিতে সুরক্ষা সেবা বিভাগের জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বিদ্যমান অবকাঠামো ও জনবল নির্বাচন কমিশন থেকে সুরক্ষা সেবা বিভাগে হস্তান্তরের ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে বলে উল্লেখ করা হয়।

চিঠিতে জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন কার্যক্রম নির্বাহী বিভাগের দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় বিভিন্ন দেশের উদাহরণের আলোকে সুরক্ষা সেবা বিভাগ ওই দায়িত্ব পালনে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ বিবেচিত বলে উল্লেখ করা হয়।

গত বছরের জুলাইয়ের শেষ দিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এনআইডির দায়িত্ব তাদের কাছে দেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে প্রস্তাব পাঠায়। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় গত ৬ আগস্ট এ বিষয়ে মতামত চেয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকে চিঠি দেয়। সে সময় জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধনের দায়িত্বপ্রাপ্ত স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ও জাতীয় পরিচয়পত্রের নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনা তাদের দায়িত্বে পেতে আগ্রহ প্রকাশ করে।

মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এ বিষয়ে একটি কমিটি গঠন করে এবং ওই কমিটি নাগরিকদের পরিচয়পত্রের গুরুত্বপূর্ণ এই কাজের দায়িত্ব মন্ত্রিপরিষদের নিয়ন্ত্রণাধীন সিভিল রেজিস্ট্রেশন অ্যান্ড ভাইটাল স্ট্যাটিস্টিকসকে (সিআরভিএস) দেওয়ার সুপারিশ করে। তাতে বলা হয়—মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর তত্ত্বাবধানে থেকে সব মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে। নাগরিকের ঠিকানা, জন্ম, মৃত্যুসহ অন্য তথ্যাদির বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সিআরভিএস কার্যক্রম পরিচালনা করে। জাতীয় পরিচয়পত্রও এক ধরনের সিভিল রেজিস্ট্রেশন। সুতরাং জাতীয় পরিচয়পত্রসহ অন্যান্য সিভিল রেজিস্ট্রেশনের সব কার্যক্রম নির্বাহী কর্মকাণ্ড হিসেবে বিদ্যমান আইন, নীতি ও বিধি সংশোধনক্রমে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অধীনে একটি কর্তৃপক্ষের আওতায় ন্যস্ত করার পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে। এ ছাড়া বলা হয়, ‘জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন তথ্যভাণ্ডার নাগরিকদের পরিচয়পত্র প্রস্তুতসহ ১২৭টি চুক্তিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহায়তা প্রদান করছে। এখন পর্যন্ত জাতীয় পরিচয়পত্রের মাধ্যমে ২২ ধরনের সেবা দেওয়া হয়, যার বেশির ভাগই নির্বাহী ধরনের। ভবিষ্যতে এর কর্মপরিধি আরো বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। এনআইডি নিবন্ধন কার্যক্রম আরো নিরাপদ ও জনবান্ধব করার জন্য উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের বিবেচনার প্রয়োজন রয়েছে।’ কিন্তু ওই মতামত গ্রহণ করা হয়নি। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কেই এনআইডি কার্যক্রম পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণের পক্ষে মত দিয়েছে।

বিদ্যমান জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইনে নাগরিকদের জাতীয় পরিচয়পত্র দেওয়ার ক্ষমতা ও এখতিয়ার নির্বাচন কমিশনের। জাতীয় পরিচয়পত্রে থাকা তথ্য-উপাত্ত সংশোধন, সংযোজন ও বিয়োজনের কাজও ইসির অধীন জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগ ও মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা করে আসছেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশনা বাস্তবায়িত হলে সেই কার্যক্রম স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হাতে চলে যাবে। অথচ ভোটার তালিকা আইন, ২০০৯ অনুসারে নতুন ভোটার অন্তর্ভুক্ত বা মৃতদের নাম তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার এখতিয়ার ইসির হাতেই থাকবে। বর্তমানে নতুন ভোটার অন্তর্ভুক্তি ও জাতীয় পরিচয় সংক্রান্ত সেবা একই সার্ভার থেকে দিয়ে আসছে ইসি।

নির্বাচন কমিশন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশন স্মারকলিপিতে বলেছে, নির্বাচন কমিশন বিগত ১৪ বছর যাবৎ দেশব্যাপী নিজস্ব অফিসগুলোর মাধ্যমে জাতীয় পরিচয়পত্র সংক্রান্ত কার্যক্রম সম্পন্ন করে আসছে। ভোটার তালিকা ও জাতীয় পরিচয়পত্র প্রস্তুত ও বিতরণসংক্রান্ত কাজে এ পর্যন্ত প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকার বেশি খরচ হয়েছে। নতুনভাবে অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছে জাতীয় পরিচয়পত্রের সার্ভার হস্তান্তরিত হলে ওই প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো গড়ে তোলা, নতুনভাবে কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ, কর্মপরিকল্পনা প্রস্তুত, লজিস্টিক ব্যবস্থাপনাসহ নানা কাজে সরকারের হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ হবে। সরকারি অর্থ সাশ্রয়ের জন্য জাতীয় পরিচয়পত্রের কাজের ধারা বর্তমানে যেভাবে নির্বাচন কমিশনের অধীনে চলমান, সেভাবে রাখা প্রয়োজন।

নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা স্মারকলিপিতে কয়েকটি প্রশ্নও উত্থাপন করেছেন। প্রশ্নগুলো হলো : ১. জাতীয় পরিচয়পত্রের সার্ভার অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছে হস্তান্তর করলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান নতুনভাবে ডাটা কিভাবে সংগ্রহ করবে, নির্বাচন কমিশনের ভোটার তালিকার সার্ভার অন্য প্রতিষ্ঠানের কাছে হস্তান্তর আইনসংগত হবে কি না; ২. নির্বাচন কমিশনের ভোটারদের ডাটা সংগ্রহ ও অন্য প্রতিষ্ঠান কর্তৃক নাগরিকদের তথ্য সংগ্রহ করে নতুনভাবে সার্ভার স্থাপন, নাগরিকদের তথ্য ও পরিচিতি সংক্রান্ত একই কাজের জন্য নির্বাচন কমিশন ও অন্য প্রতিষ্ঠান কর্তৃক একাধিক সার্ভার প্রস্তুত, রক্ষণাবেক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা ব্যয় বাড়ানো কতটা যুক্তিসংগত; ৩. যদি একই কাজের দ্বৈততা পরিহারের জন্য নাগরিকদের তথ্য অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান সংগ্রহ করে থাকে এবং এর ভিত্তিতে ভোটার তালিকা তৈরির জন্য ওই প্রতিষ্ঠান নির্বাচন কমিশনকে ডাটা সরবরাহ করতে সম্মত হয়, তাহলে সে ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন কর্তৃক ভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে ডাটা নিয়ে ভোটার তালিকা প্রস্তুত করা কতটা আইনসংগত এবং ওই ভোটার তালিকা দিয়ে নির্বাচন করলে জনগণের কাছে তা গ্রহণযোগ্য হবে কি না; ৪. যেসব প্রতিষ্ঠান জাতীয় পরিচয়পত্রের সেবাসংক্রান্ত বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে, তাদের সেবা প্রদান বিঘ্নিত হবে কি না।

নির্বাচন কর্মকর্তারা এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে নির্বাচন কমিশনের অধীনে জাতীয় পরিচয়পত্রের কার্যক্রম অব্যাহত রাখা এবং আরো দ্রুত কিভাবে এই সেবা দেওয়া যায়, সে বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য নির্বাচন কমিশনারদের কাছে আবেদন জানিয়েছে।