জাতীয়

হলমার্কের পাঁচশ কোটি টাকার সম্পদ বেহাত


Warning: strlen() expects parameter 1 to be string, array given in /home/khalinews/public_html/wp-includes/functions.php on line 262
(Last Updated On: )

সাভারের হেমায়েতপুর-সিঙ্গাইর রোডের তেঁতুলঝোড়া ব্রিজ। এর আশপাশেই প্রায় ১৩৭ একর জায়গাজুড়ে বহুল আলোচিত হলমার্ক গ্রুপের বিভিন্ন কারখানার অবস্থান। কিন্তু ৮ বছরের ব্যবধানে কারখানা এলাকায় ভুতুড়ে পরিবেশ। কোথাও মানুষের আনাগোনা নেই। কারখানার ভঙ্গুর অবকাঠামো ছাড়া লুটপাট হয়ে গেছে অন্তত ৫০০ কোটি টাকার মেশিনারিজ। পরিত্যক্ত অবস্থায় থাকতে থাকতে কারখানার ভেতরে জন্মেছে ঘাস, গাছপালা। অনেক জায়গায় খুলে পড়েছে ভবনের বিভিন্ন অংশ, পলেস্তারা। বেহাত হওয়ার পথে হলমার্কের অনেক জমিও। অনুসন্ধানে পাওয়া গেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য, স্থানীয় কয়েকজন প্রভাবশালী রাজনৈতিক ও জনপ্রতিনিধি হলমার্কের এসব মেশিনারিজ লুটপাটে জড়িত। এ কারণে মুখ খুলতে রাজি হননি কেউ।

জানা গেছে, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) যখন হলমার্কের বিরুদ্ধে মামলা করে, তখন হলমার্কের স্থাবর সম্পত্তি ক্রোক হয়নি। সেই সুযোগটা কাজে লাগাচ্ছেন প্রভাবশালীরা। দুদক আইনজীবী রুহুল ইসলাম বলেন, ‘রায় হলে হলমার্কের সম্পদ সরকারের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত হবে। এ ছাড়া গণমাধ্যমে সম্পদ বেহাতের বিষয়ে তথ্যবহুল চিত্র এলে আমরা তা আদালতের নজরে আনতে পারব।’ দুদক সূত্রে জানা গেছে, হলমার্ক গ্রুপ ফান্ডেড ও নন-ফান্ডেড ঋণ সুবিধার অংশ হিসেবে জালিয়াতি করে প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিল। বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর ২০১২ সালে হলমার্কের বিরুদ্ধে মোট ৩৮টি মামলা করে দুদক।

প্রাপ্ত তথ্যমতে, হলমার্কের এমডি তানভীর মাহমুদের সর্বমোট ৬৫টি শিল্পকারখানা রয়েছে। এসব কারখানায় কাজ করতেন প্রায় ৪০ হাজার শ্রমিক। তবে তানভীরের গ্রেপ্তারের পরই বন্ধ হয়ে যায় এসব কারখানা। যদিও সম্প্রতি আলোচনা উঠেছে, তানভীর ও জেসমিন ইসলাম জামিনে বের হয়ে ব্যবসা পরিচালনা ও সম্পত্তি বিক্রির মাধ্যমে সোনালী ব্যাংকের দেনা শোধ করবেন। এ নিয়ে আলোচনা চলছে দুদক, ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ও সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলে। কারাবন্দি তানভীর মাহমুদ ব্যাংকের অর্থ পরিশোধের প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রধানমন্ত্রীসহ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সংস্থার কাছে চিঠি পাঠিয়েছিলেন। এর মধ্যে ২০১৩ সালে প্রধানমন্ত্রীকে, ২০১৬ সালে সরকারি হিসাব সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির কাছে, ২০১৭ সালে সোনালী ব্যাংকের চেয়ারম্যানের কাছে এবং ২০১৯ সালে অর্থমন্ত্রীর কাছে লিখিত আবেদন করেন। আবেদনে বলা হয়, ৫০০ কোটি টাকার মূল্যবান যন্ত্রপাতিসহ ৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকার সম্পদ ধ্বংস হচ্ছে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো জাতীয় সংসদের সাব-কমিটির প্রতিবেদনে আদালতের বাইরে সমঝোতার মাধ্যমে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণের নির্দেশনা দেওয়া হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে সোনালী ব্যাংকও সাব-কমিটির ওই নির্দেশনা পায়। তারই আলোকে গত কয়েক বছরে অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো সোনালী ব্যাংকের ছয়টি চিঠিতে সোনালী ব্যাংক, বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয়, দুদক; আইন, ভূমি ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা করে পাওনা টাকা আদায়ে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণের অনুরোধ জানানো হয়।

তবে প্রশ্ন উঠেছে, তানভীর ইসলাম ও জেসমিন ইসলামের জামিন হলেও আদৌ এসব কারখানা কি সচল করা সম্ভব! বিশাল এলাকাজুড়ে যেসব কারখানা রয়েছে, তাও ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। কোনো মেশিনারিজও নেই। জমি বিক্রি ছাড়া টাকা পরিশোধে অন্য কোনো উপায় নেই হলমার্ক গ্রুপের।

সরেজমিনে হলমার্কের কারখানা এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, কোনো নিরাপত্তারক্ষী নেই। কয়েকটি কারখানার ছাদ ফুটো হয়ে পানি জমে রয়েছে। কারখানার টিনশেড ভবনের লোহার বিভিন্ন জিনিসও খুলে নেওয়া হয়েছে। কোনো কোনো কারখানার মধ্যে কেবল লোহার পাত রয়েছে। খুলে নেওয়া হয়েছে মেশিনারিজ। আর যেসব মেশিনারিজ খুলে নেওয়া সম্ভব হয়নি, সেগুলোর বশিরভাগ যন্ত্রপাতি মরিচা পড়ে নষ্ট হয়ে গেছে।

হলমার্কের মালামাল লুটের বিষয়ে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে পাওয়া গেছে অভিন্ন তথ্য। স্থানীয় এক প্রভাবশালী জনপ্রতিনিধির প্রত্যক্ষ মদদেই এসব মালামাল লুটপাট হয়েছে। কোটি কোটি টাকার সম্পদ সরিয়ে ফেলা হয়েছে রাতের আঁধারে। পাশাপাশি স্থানীয় কয়েকজন প্রভাবশালী রাজনীতিকও বিভিন্ন মালামাল লুট করেছেন। হলমার্ক গ্রুপে কাজ করা সাবেক এক কর্মকর্তা বলেন, গ্রেপ্তারের কিছুদিন পরই জামিনে বের হয়েছিলেন জেসমিন ইসলাম। ওই সময় তিনি কিছু মেশিন ও অন্যান্য সামগ্রী বিক্রি করেছিলেন। এর পর থেকে হলমার্কের কারখানাগুলো থেকে স্থানীয় প্রভাবশালীরা নিয়মিতভাবে নানা মেশিনারিজ ও দ্রব্যাদি বিক্রি করছেন দেদারসে।

স্থানীয়রা বলেন, প্রভাবশালীরা যে যার ইচ্ছামতো হলমার্কের মালামাল সরিয়ে বিক্রি করেন। জমি আর পরিত্যক্ত ভবন ছাড়া তেমন কোনো মেশিনারিজ এখন আর নেই। পুরো হলমার্ক এলাকা বর্তমানে অপরাধীদের নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

এ ছাড়া হলমার্কের তানভীর গ্রেপ্তার হওয়ার সময় কয়েকটি কারখানা ভবন নির্মাণাধীন ছিল। সে ভবনগুলোও অব্যবহৃত থাকায় ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

তেঁতুলঝোড়াসহ আশপাশের এলাকায় মোট ৪৩টি কারখানার মধ্যে ৪০টি কারখানা বন্ধ রয়েছে আট বছর ধরে। তবে ধ্বংসপ্রায় এ প্রকল্পে এখনো তিনটি কারখানা কোনো রকমে সচল আছে। কয়েকজন ছোট ছোট ব্যবসায়ী সাব কন্ট্রাক্টে ভাড়া নিয়ে এসব কারখানা ১০ থেকে ১৫ জন শ্রমিক দিয়ে চালু রেখেছেন। অনেকটা গোপনেই চলছে উৎপাদন কর্মকাণ্ড। বর্তমানে কারখানা ৩টিতে নিটিং লেবেল তৈরি ও এমব্রয়ডারির কাজ করা হয়।

তেঁতুলঝোড়ায় হলমার্কের প্রজেক্টের শেষ প্রান্তে ছিল গরুর সাতটি বড় বড় শেড (খামার)। এর মধ্যে দুটি শেডে শুধু লোহার অ্যাঙ্গেল দৃশ্যমান রয়েছে। বাকি ৫টি শেডের টিন ও লোহার সব মালামাল কেটে লুটপাট করা হয়েছে। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এসব খামারে এক সময় প্রায় আড়াই থেকে তিন হাজারের বেশি গরু পালন হতো।

আনসার ক্যাম্পের এক সদস্য জানান, হলমার্ক গ্রুপের অনেক বড় একটি স্পিনিং মিল ছিল। ওই মিলের জন্য জার্মানি ও জাপান থেকে অত্যাধুনিক মেশিন আমদানি করা হয়েছিল। হলমার্ক গ্রুপের কর্ণধার তানভীর মাহমুদ আটক হওয়ার সময় মেশিনগুলো নতুন অবস্থায়ই প্যাকেট করা ছিল। এসব মেশিনারিজ পরে রাতের আঁধারে স্থানীয় প্রভাবশালী এক নেতার লোকজন কারখানা থেকে নিয়ে গেছেন।

হলমার্ক গ্রুপের আশপাশে থাকা অন্তত দুটি কারখানার মালিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বিষয়টি ‘ওপেন সিক্রেট’। হলমার্কের মালামাল আশপাশের প্রায় সব কারখানায় বিক্রি করা হয়েছে। এ ছাড়া বড় বড় কয়েকটি কারখানায়ও হলমার্কের উন্নতমানের মেশিনগুলো বিক্রি করা হয়েছে। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, স্থানীয় প্রভাবশালীদের হলমার্কের কারখানার মেশিনারিজ বা অন্য গুরুত্বপূর্ণ জিনিস বিক্রি করতে কারও অনুমতির প্রয়োজন হয় না। বিষয়টি এমন দাঁড়িয়েছে, কারও টাকা-পয়সার প্রয়োজন হলেই হলমার্কের কারখানার কিছু না কিছু বিক্রি করে দিচ্ছে। প্রথমদিকে রাতের আঁধারে এসব বিক্রি চললেও পরে দিনের আলোতেও লুটপাট হয়েছে।

তিনি বলেন, হলমার্কের যেসব উন্নতমানের মেশিনারিজ ছিল। চাইলে সবকটি কারখানা আবার সচল করা যেত। কিন্তু এখন আর সেটা সম্ভব নয়। কয়েকটি মেশিন থাকলেও দীর্ঘদিন অব্যবহৃত থাকায় তা আর সচল হবে না।

এ বিষয়ে তানভীর মাহমুদের আইনজীবী শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘বিষয়গুলো আমার জানা নেই। দুদকের যেসব মামলা রয়েছে, আমি শুধু সেগুলো দেখি।’

স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এবং এলাকার প্রভাবশালী রাজনীতিকদের কেউ কেউ হলমার্কের সম্পদ সরিয়ে নিচ্ছে, এ বিষয়ে কিছু জানেন কিনাÑ এমন প্রশ্নের জবাবে সাভার উপজেলা চেয়ারম্যান মঞ্জুরুল আলম রাজিব আমাদের সময়কে বলেন, ব্যাংক কর্তৃপক্ষ, দুদক, পুলিশসহ অনেকেরই নজরদারিতে রয়েছে এ সম্পদ। চাইলেই কেউ এসব বিক্রি করতে পারে না।

হলমার্কের নানা মেশিনারিজ ও সম্পদ বিক্রির সঙ্গে আপনার লোকজন জড়িতÑ এমন অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এটা ডাহা মিথ্যা কথা। অসম্ভব। প্রায়ই হলমার্কের লোকজন এসব বিক্রি করে দিচ্ছে। তেমন কিছুই নাই এখন।’