জাতীয়

জীবিকায় টান, জীবনেও


Warning: strlen() expects parameter 1 to be string, array given in /home/khalinews/public_html/wp-includes/functions.php on line 262
(Last Updated On: )

সরকারের সিদ্ধান্তে আগামী ১৪ এপ্রিল বুধবার থেকে শুরু হচ্ছে এক সপ্তাহের ‘সাধারণ ছুটি’। কার্যত এ ছুটির মোড়কে দেশব্যাপী চলবে সর্বাত্মক লকডাউন। সব সরকারি /আধা সরকারি/স্বায়ত্তশাসিত তো বটেই, বেসরকারি অফিস-আদালতও এ সময় সম্পূর্ণ বন্ধ থাকবে; বন্ধ থাকবে শপিংমল-দোকানপাট, গণপরিবহন। আসন্ন এ অচলাবস্থার সর্বগ্রাসী প্রভাব পড়বে দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ওপর। নিম্নআয়ের মানুষের জীবিকার কী হবে? কীভাবে বাঁচবে তাদের জীবন? এমন সব প্রশ্ন উঠে এসেছে সাধারণ ছুটির ঘোষণা নিয়ে সরকারের চিন্তাভাবনা শুরু হওয়ার পর থেকেই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি; দেখা যায়নি এ থেকে উত্তরণের পথ। এমতাবস্থায় খাদ্য নিরাপত্তার ফাঁদে পড়া দেশের প্রায় ১ কোটি ৭০ লাখ অতিদরিদ্র মানুষের কী হবে- এমন প্রশ্ন মারাত্মক ভয় জাগিয়ে তোলে; উত্তরও অজানা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, লকডাউনে দরিদ্ররা পড়বে উভয় সংকটে। একদিকে না থাকে জীবিকা, অন্যদিকে না বাঁচে জীবন- এহেন দশায় পড়ে হাবুডুবু খাবে নিম্নআয়ের মানুষ।

জানা গেছে, আসন্ন সাধারণ ছুটিতে অর্থনীতি সচল রাখতে শিল্পকারখানা ও গার্মেন্টস খোলা রাখা হবে। শিল্পকারখানার শ্রমিক-কর্মচারীদের হেঁটেই অফিসে যেতে হবে; কোনো ধরনের পরিবহনের ব্যবস্থা থাকবে না। গতকাল রবিবার বিকাল ৩টায় মন্ত্রিপরিষদ সচিবের সভাপতিত্বে ‘জুম অ্যাপসের’ মাধ্যমে অনুষ্ঠিত বৈঠকে এমন সিদ্ধান্ত হয়েছে। সিদ্ধান্তের সার-সংক্ষেপ প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের জন্য তার কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে। তিনি অনুমোদন করলেই তা আজ সোমবার প্রজ্ঞাপন আকারে জারি করবে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। পুনরায় সাধারণ ছুটি বা লকডাউনে গেলে নিম্নআয়ের অসহায় গরিব মানুষ কীভাবে জীবিকা নির্বাহ করবে তা নিয়ে বৈঠকে কোনো আলোচনাই করেননি সরকারের কর্মকর্তারা। ফলে আসছে সাধারণ ছুটিতে এসব মানুষ চরম দুর্ভোগে পড়বে বলে আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা।

প্রসঙ্গত, গত বছর করোনা মহামারীর প্রকোপ বাড়ার মুখে ২৬ মার্চ থেকে টানা ৬৬ দিন সাধারণ ছুটিতে ছিল দেশ। ওই সময় নিম্নআয়ের মানুষ বিশেষ করে ‘যারা দিন আনে দিন খায়’ তারা চরম দুর্দশায় পড়েন। সরকার আর্থিক সাহায্য দিলেও তা বণ্টনে চরম অনিয়ম-দুর্নীতির খবর গণমাধ্যমে প্রকাশ পায়। এবারও যদি দীর্ঘমেয়াদি লকডাউন বা সাধারণ ছুটি দেওয়া হয় তা হলে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কথা সরকারের বিশেষভাবে চিন্তা করতে হবে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সিনিয়র গবেষক নাজনীন আহমেদ আমাদের সময়কে বলেন, সত্যিকার অর্থে আমরা আর লকডাউন বা সাধারণ ছুটি চাচ্ছি না। কারণ বাংলাদেশের মতো একটি দেশে লকডাউন দিয়ে জীবিকা বাঁচে না, বাঁচে না জীবনও। এখানে দরকার স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করে সবকিছু খোলা রাখা। সাধারণ ছুটিতে লোকজন বেকার বসে থাকলে অন্যান্য দেশের মতো ঘরে ঘরে খাবার পৌঁছানো কিংবা নগদ টাকা দেওয়ার সামর্থ্য সরকারের নেই। সুতরাং লকডাউন বা সাধারণ ছুটি নিম্নআয়ের মানুষকে মহাসংকটে ফেলবেই।

তিনি বলেন, যদি সরকারকেই লকডাউনে যেতেই হয় তা হলে প্রায় কোটি দরিদ্র মানুষের (এর মধ্যে প্রা ১ কোটি ৭০ লাখ অতিদরিদ্র) মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। গতবার মানুষের হাতে সঞ্চয় ছিল, এখন কিন্তু স্বল্প আয়ের মানুষের হাতে সঞ্চয় কম। কাজেই সত্যিকারের লকডাউনে গেলে অনেক বেশি সংখ্যক মানুষের সাহায্য দরকার হবে। এত মানুষের দায়িত্ব নেওয়ার প্রাতিষ্ঠানিক ও আর্থিক সক্ষমতা আমাদের আছে কি?

মন্ত্রিপরিষদ সূত্র জানায়, শুধু জরুরি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো চালু রেখে গত বছরের মতোই সাধারণ ছুটি বা লকডউনে যাচ্ছে দেশ। এ সময় লঞ্চ, ট্রেন ও বাসসহ সব ধরনের গণপরিবহন বন্ধ রাখা হবে। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক সবক’টি রুটে ফ্লাইট বন্ধ রাখবে বাংলাদেশের বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। তবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের হাইকমিশন, দূতাবাসের পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট দেশের নাগরিকদের বহনে বিশেষ ফ্লাইট চালুর সুবিধা চালু রাখা হবে। এ ছাড়া কার্গো ফ্লাইট চলাচল বিধিনিষেধের বাইরে থাকবে। কার্গো ফ্লাইটের পাইলট, ক্রুদের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিয়ম অনুযায়ী করোনা স্বাস্থ্য সুরক্ষাবিধি মানতে হবে। বন্ধ থাকবে শপিংমল ও দোকানপাট। তবে কাঁচাবাজার খোলা থাকবে।

একজন কর্মকর্তা জানান, শিল্পকারখানা খোলা থাকলেও শ্রমিকদের জন্য পরিবহন রাখার সুযোগ থাকছে না। তাদের হেঁটেই কারখানায় যেতে হবে। সুযোগ থাকলে শ্রমিকদের এই এক সপ্তাহ কারখানার ভেতরেই অথবা আশপাশে আবাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। শিল্পকারখানার গেট বন্ধ রাখতে হবে।

অর্থনীতিবিদ নাজনীন আহমেদ আরও বলেন, টানাটানিতে চলা লোকজন কারও কাছে হাত পাততে পারবেন না। কিন্তু খাদ্য কষ্টে থাকবেন। এদেরও কিন্তু সরকারি সাহায্যের প্রয়োজন হবে। আবারও বলছি, গত বছর এ সংকটে মানুষ যতটা না পড়েছে, এবার তার চেয়ে বেশি হবে। কারণ অনেক মানুষের সঞ্চয় একেবারেই নেই। এত বিপুলসংখ্যক মানুষের জন্য খাদ্য কিংবা আয়ের নিরাপত্তা অথবা কর্মসংস্থানের নিরাপত্তা দেওয়ার উপায় কী হবে?

লকডাউন বা সাধারণ ছুটি না দিয়ে কী উপায়ে করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় এমন প্রশ্নে তার পরামর্শ, আমার মতে সব ধরনের সভা-সমাবেশ জনসমাগম বন্ধ করে কঠোর স্বাস্থ্যবিধি মানা নিশ্চিত করতে হবে। সংক্রমণ প্রতিরোধমূলক মাস্ক, সাবান ইত্যাদি ব্যাপকভাবে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিতরণ করতে হবে। এ সংক্রান্ত প্রচার-প্রচারণা জোরদার করতে হবে। স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিদের সহযোগিতায় গ্রাম পর্যায়ে পর্যন্ত সচেতনতা বাড়াতে হবে। সর্বোপরি স্বাস্থ্যবিধি মানা কঠোরভাবে ইমপ্লিমেন্ট করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তা নিতে হবে।

সূত্র জানায়, আসছে সাধারণ ছুটিতে সব ধরনের গণপরিবহন (সড়ক, নৌ, রেল ও অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট) বন্ধ থাকবে। তবে পণ্য পরিবহন, উৎপাদন ব্যবস্থা, জরুরি সেবার ক্ষেত্রে এ আদেশ প্রযোজ্য হবে না। দুই. আইনশৃঙ্খলা এবং জরুরি পরিষেবা, যেমন- ত্রাণ বিতরণ, স্বাস্থ্যসেবা, বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস, জ্বালানি, ফায়ার সার্ভিস, বন্দর (স্থল, নৌ ও সমুদ্রবন্দর) কার্যক্রম, টেলিফোন ও ইন্টারনেট, সংবাদপত্র, ডাক সেবাসহ অন্যান্য জরুরি ও অত্যাবশ্যকীয় পণ্য ও সেবার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অফিস চালু থাকবে। কাঁচাবাজার ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত উন্মুক্ত স্থানে স্বাস্থ্যবিধি মেনে কেনাবেচা করা যাবে। বাজার কর্তৃপক্ষ বা স্থানীয় প্রশাসন বিষয়টি নিশ্চিত করবে। ব্যাংকিং ব্যবস্থা সীমিত পরিসরে চালু রাখার বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেবে। সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ ঢাকার সুবিধাজনক স্থানে ফিল্ড হাসপাতাল স্থাপনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। সারাদেশে জেলা ও মাঠ প্রশাসন এসব নির্দেশনা বাস্তবায়নের কার্যকর পদক্ষেপ নেবে এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিয়মিত টহল জোরদার করবে। আর সরকারি আদেশ অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনুনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আপাত এক সপ্তাহের সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হবে। পরিস্থিতি বিবেচনায় এ ছুটি আরও বাড়তে পারে।

মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলামের সভাপতিত্বে জুম মিটিংয়ে প্রায় ৬০ জনের বেশি কর্মকর্তা যোগ দেন। তাদের মধ্যে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব, সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব, রেল সচিব, বাংলাদেশ পুলিশের মহাপরিদর্শক, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, ডিজিএফআইয়ের মহাপরিচালক, এনএসআইয়ের মহাপরিচালক প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন বলে জানা গেছে।